কুসুম্বা মসজিদ

একটি দেশের সমৃদ্ধির অনেকখানি নির্ভর করে সেই দেশের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যর যথাযথ সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্মর কাছে সেগুলো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার উপরে। ইতিহাস আর ঐতিহ্য সঠিক ও আকর্ষণীয়ভাবে ভাবে একটি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে।

এভাবে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মাঝে সেই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি জানার, দেখার আর উপলব্ধি করার আগ্রহ ও আকর্ষণ তৈরি হবে। যেটা এক সময় সেই দেশের আদি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি নানা ভাবে সে দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

এর মধ্যে অন্যতম হল সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরে সে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো। যেটা আমাদের পাশের দেশ ভারত খুব ভালভাবে করছে। আর তাদের সেইসব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি উপভোগ করতে শুধু তাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মই নয়, সারা বিশ্ব থেকে তরুনরা ছুটে আসছে প্রতিদিন।

যার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ বর্তমানে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। যেটা তাদের সেসব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি সংরক্ষণের পাশপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, সর্বোপরি সমৃদ্ধিতে কি দারুণ প্রভাব ফেলছে, সেটা আমরা যারা ভারতের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে যাই, তারা সবাই জানি, হয়তো সেভাবে ভেবে দেখিনি।

আজ আমাদের তেমন একটি ঐতিহ্য আর সেই ঐতিহ্যকে ঘিরে আমাদের পর্যটনের একটি সম্ভাবনার গল্প বলবো। যেটা খুব বেশী না হলেও, অল্প করে হলেও আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এবার গল্পটা বলি…

ফিরছিলাম সব সময়ের প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোন চষে বেরিয়ে। সকাল ৯ টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে রাবি দেখা শেষ করে, হালকা লাঞ্চ করে নওগাঁর দিকে বাসে করে। বাসে ওঠার পরেই মনে হল, আরে হাতে তো বেশ সময় আছে তাহলে যদি সম্ভব হয় আর খুব দূরের পথ না হয় তবে নওগাঁর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা কুসুম্বা মসজিদ দেখে যাওয়া যায় কিনা?

বাসের হেল্পারকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো একদম রাস্তার প্রায় কাছেই কুসুম্বা গ্রাম! বাস থেকে নেমে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবো কুসুম্বা মসজিদ! তাহলে তো আর কথাই নেই। বলে রাখলাম যেন কুসুম্বা নামিয়ে দেয়। রাজশাহী থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরের কুসুম্বায় নামিয়ে দিল ঠিক এক ঘণ্টা পরে। এক জনকে জিজ্ঞাসা করতেই বামের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল একটু সামনেই। মিনিট দুই হাটার পরেই গাছের ফাঁকা দিয়ে একটু দূরে বেশ পুরনো গম্বুজ চোখে পড়লো। বুঝতে বাকি রইলোনা যে ওটাই সেই ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদের গম্বুজ। যেটার ছবি আমাদের দেশের একটি জাতীয় মুদ্রা পাঁচ টাকার নোট আছে।

ঠিক পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মসজিদের কাছে। কি দারুণ পাথরের কারুকাজে মণ্ডিত ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সমহিমায় দাড়িয়ে থেকে নিজের ঐতিহ্যকে জানানা দিয়ে যাচ্ছে, আফগান শাসক গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহর আমলের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে। সেই সময়ের এই মসজিদ আজও তার আপন মহিমায় দাড়িয়ে আছে। পুরো মসজিদটা কালো পাথরের উপরে নানা রকম নকশায় তৈরি। যার বাঁকানো ছাদ বাংলার কুঁড়ে ঘরের আদলে নির্মিত। সামনে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ আর দক্ষিণ পাশেও রয়েছে পথ যা এখন পাথরের খিলান দিয়ে বন্ধ করা। মসজিদের ছাঁদে গোলাকার ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। কথিত আছে মসজিদের একটি নির্ধারিত যায়গায় মহিলাদের জন্য রয়েছে নামাজের স্থান।

সবকিছু মিলে দারুণ নান্দনিকতায় দাড়িয়ে রয়েছে সেই ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে! দেখেই কেমন যেন একটা প্রশান্তিতে মন ভরে উঠবে আপনার। দারুণ একটা তৃপ্তি ছুঁয়ে যাবে আপনাকে।পাশে রয়েছে মুসল্লিদের সব সময়ের জন্য ছায়া দিয়ে যাওয়া এক বিশাল তেতুল গাছ, চারপাশের বাগানা ছিল বোঝা যায়, যেখানে এখন সংস্কার কাজ চলছে। মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল পাথরের উঠোন, মুসুল্লিদের বসে বসে সামনের বিশাল দিঘির নরম বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য।

সেখানেও নানা রকম সংস্কার কাজ চলমান।চারপাশে তৈরি হয়েছে পায়ে হাটার রাস্তা। তবে যদি পাশের দীঘি বা কল থেকে পবিত্র হয়ে নামাজ পড়তে পারেন এক ওয়াক্ত তবে বোধয় মনের প্রশান্তিটা আরও অনেক বেশী হবে।

তবে মসজিদের পাশপাশি এখানে রয়েছে আর একটি অপূর্ব আকর্ষণ! সেটা হল প্রায় ৭৮ বিঘার উপরে তৈরি করা বিশাল এক দীঘি! যার রয়েছে একাধিক শাণ বাঁধানো ঘাট, টলটলে পানি, চারদিকে সবুজের সমারোহ, নানা রকম মাছ আর দীঘির পাড়ে বসে সময় কাটানোর দারুণ এক বিলাসী আয়োজন।

এতোকিছু আছে শুধু নেই এই দারুণ ঐতিহ্যর তেমন কোন সংরক্ষণ, নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার কোন প্রয়াস, না আছে সঠিক কোন ব্যাবস্থাপনা! অথচ এমন বিশাল একটা দীঘিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে পারে স্থানীয় একটা অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ!

ছোট ছোট কটেজ করা যেতে পারে দীঘির চারপাশ ঘিরে, যেখানে দূর-দূরান্তের মানুষজন এসে থেকে যেতে পারে একটি বেলা বা একটি দিন। যার সাথে রয়েছে সেই ১৬ শতকের এমন নান্দনিক একটা ঐতিহাসিক স্থাপনা। এমনকি এখানে যাওয়া-আসার যোগাযোগ ব্যাবস্থাও যথেষ্ট ভালো। একেবারেই ঝামেলামুক্ত।

তবে এটা ঠিক যেহেতু শুধু কুসুম্বা মসজিদ দেখতে কেউ হয়তো হুট করে আসতে চাইবেনা প্রচারনার অভাবে। তবে একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্যন্য রূপ উপভোগ করার পাশাপাশি দেখে আসতে পারেন ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আর ৭৮ বিঘার বিশাল দীঘির নান্দনিকতা।

ঢাকা থেকে রাজশাহী অথবা নওগাঁ হয়ে কুসুম্বা যাওয়া যায়। নওগাঁ থেকে দুরত্ত ৩৩ কিলোমিটার আর রাজশাহী থেকে ৫২ কিলোমিটার। হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখে কুসুম্বা হয়ে নওগাঁ থেকে ঢাকা, অথবা নওগাঁ থেকে পাহাড়পুর বা কুসুম্বা দেখে রাজশাহী হয়ে ফিরতে পারেন ঢাকা বা অন্য কোন জেলায়। থাকা-খাওয়ার খরচ অন্য যে কোন জেলা শহরের চেয়ে কম হবে বেশী নয়।

Post Copied From:Sajol Zahid‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

পাহাড়পুর

পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই শুধু নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।

পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ (বর্তমান বানগড়)-এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর মহাবিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত
নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। অপরদিকে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব পশ্চিমদিকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৫°০´ উত্তর থেকে ২৫°১৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫০´ পূর্ব থেকে ৮৯°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত। গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ কিলোমিটার (১০ হেক্টর ) অঞ্চল জুড়ে এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভূজ আকৃতির। [১] এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত, প্লাইস্টোসীন যুগের বরেন্দ্র নামক অনুচ্চ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মাটিতে লৌহজাত পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাটি লালচে। অবশ্য বর্তমানে এ মাটি অধিকাংশ স্থানে পললের নিচে ঢাকা পড়েছে। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন একে গোপাল চিতার পাহাড় আখ্যায়িত করত; সেই থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর, যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পর তাঁরা সকল স্থানে জরিপ কাজ চালানো শুরু করেন। পূর্ব ভারতে জরিপ কাজ পরিচালনা করেন বুকানন হ্যামিল্টন ; যিনি ১৮০৭ থেকে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে পাহাড়পুর পরিদর্শন করেন। এটিই ছিল পাহাড়পুরে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন। এরপর এই প্রত্নস্থল পরিদর্শনে আসেন
ওয়েস্টম্যাকট। এঁরা দেশে ফিরে তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্বলিত বিবরণ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এরই সূত্র ধরে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পর এই জমিটি ব্যাপক হারে খনন করার প্রতি তিনি আগ্রহ দেখান। কিন্তু জমির মালিক বলিহারের তদানীন্তন জমিদার তাঁকে এই কাজে বাধা দেন। তাই তিনি বিহার এলাকার সামান্য অংশে এবং পুরাকীর্তির কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগের সামান্য অংশে খনন কাজ চালিয়েই অব্যাহতি দেন। এই খননকার্যের সময় কেন্দ্রীয় ঢিবির অংশে চারপাশে উদ্গত অংশবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত আবিষ্কার করেন যার দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। [২] অবশেষে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় এই স্থান ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষিত হয়।

কিভাবে যাবেন:ঢাকা টু নওগাঁ বাস।নওগাঁ টু বিহার লোকাল ট্রান্সপোর্ট (বাস)।

Post Copied From:Md Abdus Satter Sohag>Travelers of Bangladesh (ToB)