নেপলস্ ( ইতালী)

আড়াইশ বছর আগের কথা । ইতালী নামের দেশটির তখনো জন্মই হয় নি । এখনকার ইতালীর বড় শহর ‘নেপলস্’ তখন একখানা নগররাজ্য মাত্র । সেই নেপলসেরই রাজামশাই শহরের অদূরে ভিসুভিয়াস পর্বতের ঢালে একখানা গ্রীষ্মনিবাস তৈরী করবেন বলে ঠিক করলেন । গ্রীষ্মের চিটচিটে গরমে মেডিটেরিয়ান সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাস উপভোগের জন্য পাহারের উঁচু ঢালে গ্রীষ্মনিবাস আরামদায়কই বটে । তবে সমস্যা হলো পাহাড়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা বেশ জটিল । সুতরাং, পানির খোঁজে পাঠানো হলো রাজকীয় ইন্জিনিয়ার বাহিনী । শুরু হলো খোঁজ । পানির জন্য খুঁড়োখুঁড়ি করতে করতে বের হয়ে আসলো মার্বেল পাথর; প্রথমে দু-এক টুকরো, তারপর আরোও বেশী । টনক নড়ল ইন্জিয়ারদের । এখানে তো মার্বেল পাথর আসার কথা নয় ! তবে?
.
পানি বাদ দিয়ে শুরু হলো অন্য এক খোঁজ, আর তাতেই বের হয়ে আসল যীশুখ্রীষ্ট জন্মেরও আগেকার এক প্রলয়ংকারী ঘটনার গল্প, যা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল সময়ের সাথে সাথে ।
.
খ্রীষ্ট জন্মের প্রায় সাতশ’ বছর, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাতাশ শ’ বছর আগে মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের একটি ছোট্ট বন্দর হিসেবে গোড়াপত্তন হয় একটি শহরের, নাম তার ‘পম্পেই’ । প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসাবান্ধব নিরাপদ বন্দরনগরী হিসেবে আস্তে আস্তে পম্পেই-এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। স্বাভাবিক ভাবেই এর সাথে সাথে আসে অর্থনৈতিক বিকাশ । কয়েকশ বছরের মধ্যেই পম্পেই ঐ অন্চলের একখানি সমৃদ্ধশালী নগররাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় । পরবর্তিতে রোমান সাম্রাজ্য বিকশিত হলে ‘পম্পেই’ চলে আসে রোমানদের অধিকারে । আধুনিক পয়: নিষ্কাষন ব্যবস্থা, মানুষ ও ঘোড়াটানা গাড়ি চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা, দোকানপাট-ব্যবসাকেন্দ্র, বিনোদনের জন্য অ্যাম্ফিথিয়েটার, গরম পানির স্টীম বাথ সহ বিশাল নাগরিক গোসলখানা, পথের মোড়ে মোড়ে বিনামূল্যে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, ব্যয়ামাগার-শরীরচর্চা কেন্দ্র, বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সহ আধুনিক নগরের সমস্থ সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবস্থাই ছিল প্রাচীন এই নগরে । সবমিলিয়ে কি চমৎকারই না ছিল পম্পেইবাসীর জীবন !
.
কিন্তু কে জানতো তারা আসলে বসবাস করছে নিশ্চিত ধ্বংসের এক বিরাট ঝুঁকির ঠিক পায়ের কাছে ! পুরো শহরটিই ছিল ভিসুভিয়াস পর্বতের পাদদেশে । প্রায় ৮,০০০ ফিট উঁচু ভিসুভিয়াস পর্বতটি আসলে একখানা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি । মাঝে মাঝে ভিসুভিয়াস দু-একটি ঝাঁকি দিয়ে জাহির করত এর জীবন্ত সত্ত্বাখানি, যদিও উত্তারোত্তর সমৃদ্ধিতে মশগুল পম্পেইবাসীরা সেই ঝাঁকি আমলেই নিত না, ঠিক যেমন ভাবে আমরা ঢাকাবাসীরা গত অনেক বছর ধরেই টুকটাক ঝাঁকি দেয়া ভুমিকম্পকে পাত্তা দিচ্ছি না।
.
অবশেষে খ্রীষ্টপূর্ব ৭৯ সালে অগাস্টের ২৪ তারিখ, অর্থাৎ আজ থেকে একুশ শ’ বছর আগে, মাউন্ট ভিসুভিয়াস প্রচন্ড দানবিক নৃশংসতায় ফেটে পরলো । প্রায় আট হাজার ফুট উঁচু ভিসুভিয়াসের পেট থেকে ফুসে বের হয়ে এলো জ্বলন্ত গ্যাস আর পাথরের রাশি ! প্রচন্ড সেই বিস্ফোরণের শক্তি ছিল হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমানবিক বোমার প্রায় কয়েক হাজার গুণ বেশী ! যার শক্তিতে ভিসুভিয়াসের পেটের ভেতর থেকে পাথর আর গ্যাস আকাশের প্রায় ৩৩ কিলোমিটার উপর পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল ! ভাবা যায় !! তারপর শুরু হলো জলন্ত লাভার স্রোত । পাথর, ছাই আর হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের লাভার সেই স্রোতে তলিয়ে গেল পুরো ‘পম্পেই’ নগরখানা – এর মানুষ-প্রাণী-গাছপালা, সভ্যতা-সমৃদ্ধি, অর্থনীতি-সংস্কৃতি সবকিছু । যে যেভাবে ছিল সেভাবেই লাভার চাপায় পরে অনন্তকালের জন্য পাথরে পরিণত হলো নিষ্টুর ভাবে । অগ্ন্যুৎপাতের কারণে তৈরী প্রচন্ড ভুমিকম্পের কারণে পাশের সমুদ্র থেকে ধেয়ে এলো সুনামী – টগবগে লাভার সাথে উত্তাল সাগরের তীব্র স্রোত এসে সৃষ্ঠি করল আরেক প্রলয় নাচন ! তারপর যখন থামল নরকের সেই খন্ডরূপ, তখন কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ।
.
বহুদূরের সাগর দিয়ে চলতে থাকা কিছু জাহাজ দূর থেকে অগ্ন্যুৎপাত দেখে রোমে গিয়ে খবর দেয় । খোঁজ নিতে রোমানরা তাঁদের দুই লিজিয়ন সৈন্য পাঠায় । প্রায় মাস খানিকের পথ পাড়ি দিয়ে সৈন্যের দল এসে দেখে কোথায় পম্পেই, কোথায় কি ! কোন কিছুরই নামগন্ধও নেই । এমন কি মানচিত্র অনুযায়ী যেখানে সমুদ্র থাকার কথা সমুদ্র চলে গিয়েছে তার থেকে প্রায় বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে ! আর ৮,০০০ ফিট ভিসুভিয়াসের উচ্চতা হয়ে গিয়েছে মাত্র ৪,০০০ ফিটের মত; অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকটা পর্বত গলে গিয়েছে অগ্ন্যুৎপাতের সাথে !
.
তারপর থেকে পম্পেই নগরটি হারিয়ে যায় প্রায় দু’হাজার বছরে জন্য নেপোলসের সম্রাটের ইন্জিনিয়ারের দল পানির খোঁজ করতে গিয়ে আবার শহরটি খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত ! কয়েকশ বছর ধরে বেশ অনেকবার খোঁজ করেও না পাওয়ায় পুরো শহরটির অস্তিত্বই আস্তে আস্তে পরিণত হয় এক কল্পকথার এক আখ্যানে যেন পুরোটাই এক কল্পনা; এ নামে কোন শহর বাস্তবে আসলে ছিলই না !
.
এবার ইতালী ট্যুরের প্ল্যান করার সময়ই পরিকল্পনা ছিল ‘পম্পেই’ যাব । TripAdvisor থেকে Day trip এর প্যাকেজ কিনে ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী একদম ভোর বেলায় রোম থেকে যাত্রা শুরু । ট্যুর বাসে মাত্র আড়াই ঘন্টা । প্রথমেই উঠলাম ভয়ংকর সেই ভিসুভিয়াসের চূড়ায় । অনেক দূর পর্যন্ত বাসে করেই উঠা যায়, বাকিটুকু পায়ে হেঁটে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে । পাহাড় বেয়ে উঠতে দারুণ কষ্ট সন্দেহ নেই তবে ওঠার পর দিগন্তবিসৃত তীব্র নীল মেডিটেরিয়ান সাগর আর তার কোলে গড়ে ওঠা পুরো নেপলস্ শহরের ছবিখানা ওঠার কষ্টটুকুকে ভুলিয়ে দেয় । মজার ব্যপার হলো ভিসুভিয়াস কিন্তু এখনও জীবন্ত ! এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে জ্বালামুখ থেকে ! ওঠার পথে চারপাশে গলিত লাভা ঠান্ডা হয়ে পরিণত হওয়া নতুন পাথরের মেলা ! কত রংগের, কত ধরণের !
.
সেখান থেকে নেমে গিয়ে ঢুকলাম ‘পম্পেই’ শহরে । আসলে বলা উচিৎ গত দেড়শ বছরে যতটুকু পম্পেইকে মাটি খুঁড়ে বের করে আনা হয়েছে ততটুকুতে । তাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ বলা যায় ! রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট, বাড়িঘর, চৌবাচ্চা-স্কুল-শহরের কেন্দ্র……… পাথরের তৈরী সবকিছুই রয়ে গিয়েছে সেরকম, শুধু কোনটিরই ছাদের অংশটুকু নেই; কারণ টন কে টন ছাই আর লাভার ভর বহন করা ছাদগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল না । আছে দোকানের বাইরে গাড়ি দাঁড় করাবার ব্যবস্থা, বসতগৃহে আছে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা, শহরের অভিজাতদের জন্য স্টীমবাথের ব্যবস্থা!!! গ্লাস-প্লেট-পিপে-হাড়ি-পাতিল-আসবাবপত্র সহ নানান ব্যবহার্য জিনিষ ! আর আছে লাভার নীচে পরে জীবন্ত অবস্থাতেই পাথর হয়ে থাকা মানুষ, পশুর মূর্তি ! অবিশ্বাস্য গায়ে কাঁটা দেয়া এক অনুভূতি ! পুরো এ্যালবামটি দেখতে পারেন এখানে http://bit.ly/2ybdI8r
.
শহরের অলি-গলিতে হেঁটে বেড়ালাম প্রায় ঘন্টা তিনেক । কানে গাইডের নিখুঁত বর্ণনা । সময় যেন এখানে থমকে আছে সেই দু-হাজার বছর আগে । যেন একটুও পুরানো হয় নি কিছুই । সবশেষে সন্ধ্যার মায়ামাখা আলো ছড়িয়ে পড়লে নানান দেশ থেকে আসা নানান বয়সী ট্যুরিস্টের আমাদের ছোট্ট দলখানা আবার বাসে উঠে বসলাম – রোমের দিকে ফিরতি পথ এবার । ইতালীর মসৃণ হাইওয়েতে বাস চলছিল নিজের গতিতে; দূরে পাহাড়ের ছায়া আর পথে পথে আংগুর, ভুট্টা আর গমের ক্ষেত । সারাদিন হেঁটে-পাহাড়ে চড়ে ক্লান্ত চোখে ঝিমুনি লাগছিল আর কল্পনায় ভাসছিল পম্পেই-এর শেষ মূহুর্তের টুকরো টুকরো ছবি ! যখন জলন্ত লাভার স্রোত ভিসুভিয়াসের গা বেয়ে ধেয়ে আসছিল শহরের দিকে, কেমন লাগছিল মানুষগুলোর তখন ? কতভাবেই না যেন শহরের প্রতিটা মা বুকে আগলে ধরে বাঁচাতে চেয়েছিল তার আদরের সন্তানটিকে ! প্রতিটা বাবা যেন কতই না চেষ্টা করেছিলেন তাঁর পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যেত ! কত প্রেমিকই প্রিয়তমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত কাছাকাছি থাকতে চাইছিল! কত কত প্রার্থনা, কত আবেদন-নিবেদন আর বুকফাটা আর্তনাদ……..সবই চাপা পরে গিয়েছিল কোটি কোটি টন নিষ্ঠুর গলিত পাথর আর ধুসর ছাইয়ের নীচে ! আহারে ! আহারে !

Post Copied From:Galib Bin Mohammad>Travelers of Bangladesh (ToB)

Leave a Reply

Your email address will not be published.