শ্রীনগর এয়ারপোর্টেই আমাদের প্রায় ২ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল, প্লেন দেরি করে আসা আর আবহাওয়ার কারনে আরও দেরি করে ছাড়ায়। তার মানে সন্ধ্যার দুরন্ত এক্সপ্রেস মিস হয়ে যাচ্ছে, কারন প্লেন দিল্লী পৌঁছান আর ট্রেন ছাড়ার সময়ের মধ্যে ২:৩০ ঘণ্টার ব্যবধান ছিল। ওদিকে দুইমাস আগেই দুরন্ত এক্সপ্রেসের টিকেট কেটে রেখেছিলাম প্রায় ৩০০০ টাকা করে! কিন্তু সেই চিন্তা করে তো আর লাভ নেই।
তবুও দিল্লীর আকাশে যখন প্লেন এলো নিচে এয়ারপোর্ট, রানওয়ে দেখতে পারছিলাম আবছা আবছা। কিন্তু প্লেন ল্যান্ড করতে পারছেনা, কারন নিচের আবহাওয়া অনেক খারাপ, যেটা উপর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। ২০ মিনিট প্লেন আকাশে চক্কর দেবার পরে যখন ল্যান্ড করলো তখন হাতে মাত্র ২০ মিনিট সময় আছে। অথচ আমাদের স্টেশনে যেতে অন্তত ৪০ মিনিট লাগবে জ্যাম না থাকলেও।
আমাদের অবস্থা জেনে একজন পরামর্শ দিলেন, ট্যাক্সি না নিয়ে যেন মেট্রোতে যাই। তাহলে অনেকটা সময় বেঁচে যাবে স্টেশনে পৌছানোর, অন্তত সন্ধ্যায় দিল্লীর ভয়াবহ জ্যামটা এড়ানো যাবে। মেট্রোর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম সেটাও এই আভ্যন্তরীণ টার্মিনাল থেকে নয়, এখান থেকে ১০ মিনিটের গাড়ি বা বাসের পথ। পড়িমরি করে উঠে পরলাম ছেলে-ছেলের মা আর ব্যাগপত্র নিয়ে দাড়িয়ে থাকা বাসে। কোন রকমে উঠতেই বাস ছেঁড়ে দিল। আর মাত্র ৮ মিনিট চলার পরেই আমাদেরকে মেট্রো স্টেশন নামিয়ে দিল। হাতে সময় আছে ১২ মিনিট, মানে নিউ দিল্লী স্টেশন থেকে দুরন্ত একপ্রেস ছাড়ার। ট্রেন পাবোনা জানি, তবুও মিথ্যে করে হলেও আশাকে বাঁচিয়ে রেখে বাকি পথটুকু চলার অনুপ্রেরণা খোঁজা।
তাড়াহুড়োতে মেট্রোতে ভুল টিকেট কাটা হয়েছিল ট্রেনের পরিবর্তে বাসের! যেটা বুঝতে পারলাম প্লাটফর্মে ঢুকতে গিয়ে, আবার সেই টিকেট ফেরত দিয়ে, মেট্রোর টিকেট কাটা হল, নিচে নেমে দেখলাম ট্রেন আসতে তিন মিনিট বাকি আছে, বড় করে লাগোয়া ট্রেনের টাইম টেবিল সেখানে অনবরত ভেসে চলেছে। ঠিক তিন মিনিট পরে ট্রেন এলো। আমরা উঠে পরলাম।
যথেষ্ট সিট ফাঁকা আছে কিন্তু ট্রেন মিসের দুশ্চিন্তা আর রাতে কোথায় থাকবে সেই টেনশনে সবাই দাড়িয়েই ছিলাম। ২৫ মিনিট পরে মেট্রো নিউ দিল্লী ষ্টেশনের উল্টো পাশে, পুরনো দিল্লীতে নামিয়ে দিল। বুকে তখনও কিছুটা মিথ্যে আশা বেঁধে রেখেছি যদি ট্রেন এক ঘণ্টা লেট হত? কিন্তু না প্লাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে কুলিদের জিজ্ঞাসা করাতে জানালো ঠিক ২০ মিনিট আগে একদম সঠিক সময়ে ট্রেন ছেঁড়ে দিয়েছে!
মানসিক প্রস্তুতি সবারই ছিল তবুও, সবাই মুহূর্তেই ভেঙে পড়লো, মানসিক ও শারীরিকভাবে। প্রত্যেকে ব্যাগের উপরে বসে পরলো, ভীষণ বিষণ্ণতায়, নিদারুণ মন খারাপ করে। ওদের এই অবস্থা দেখে দিল্লীর দালালরা আমাদেরকে পেয়ে বসলেন। ট্রেনের টিকেট নিয়ে নানা রকম ফন্দি ফিকির শুরু করে দিল। কনফার্ম টিকেট আছে, আগামীকালকের, মাত্র ৫০০ রুপী করে বেশী দিতে হবে, কেউ ৪০০ রুপী আবার কেউ ৩০০ রুপী বেশী দিয়ে ট্রেন টিকেটের নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছে। ওদের কাছে ছাড়া নাকি আগামী ৭ দিনের কলকাতার কোন টিকেট নেই! এটা শুনে ওরা চারজন আরও মুষড়ে পরলো যেন! দালালদেরকে বললাম আগে নিজ থেকে ফরেন কোটার খোঁজ নেব, তারপর অন্য ভাবনা ভেবে দেখবো। ওরা জানালো বিকেল পাঁচটার পরে ফরেন কোটার অফিস বন্ধ হয়ে যায় আর শুক্রবার বন্ধ থাকে! তবুও বললাম আগে খোঁজ নিয়ে নেই।
আমি তখনও চুপচাপ আছি। ওদেরকে একটা কর্নারে যেখানে সিসি টিভির পুরো ফুটেজ পাওয়া যায় তেমন যায়গায় ব্যাগপত্র নিয়ে বসতে বললাম। এখান থেকে আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন এক চুলও কেউ না নড়ে। ওদেরকে নুডলস কিনে দিয়ে প্লাটফর্মের দিকে হাটতে লাগলাম। আমার পিছনে পিছনে দিল্লীর দালাল লেগে আছে। ওরা যে কোন উপায়ে আমাদের টিকেট কেটে দিতে বদ্ধপরিকর।
একই সাথে পিছনে তিনজন দালাল লেগেছে, একজন ট্রেন টিকেটের, একজন হোটেল দেবার আর একজন আমাদের আগামীকাল দিল্লী ঘুরিয়ে দেখাবে পাশাপাশি আজকে রাতে আমাদের তার ট্যাক্সিতে করে এগিয়ে দেবে এবং সেজন্য কোন অতিরিক্ত টাকা নেবেনা। পূর্বে কয়েকবারের দিল্লীর দালালের নানা রকম অভিজ্ঞতা থেকে ওদের সাথে কোন রকম আলোচনা না করে নিজের মত প্লাটফর্মের ভিতরে চলে গেলাম, আর প্লাটফর্মের ভিতরে ঢোকার পরে ওরা নিজ থেকেই নিজেদের কাজে চলে গেল!
১৬ নাম্বার প্লাটফর্মে ঢুকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ফরেন টিকেট দেয়া হয় ১ নাম্বার প্লাটফর্ম থেকে। নিউ দিল্লী স্টেশনে ১৬ টা প্লাটফর্ম! খুব দ্রুত হেটে গেলেও ১৬ থেকে ১ নাম্বার প্লাটফর্মে যেতে হলে কমপক্ষে ২০ মিনিট লাগবে। এতক্ষণে আমার নিজেরও বেশ ক্লান্তি চলে এসেছে, সেটা যতটা না শারীরিক তারচেয়ে বেশী মানসিক। জানেন তো মানসিক ক্লান্তি মানুষকে বেশী দুর্বল করে দেয়।
যাই হোক ১ নাম্বার প্লাটফর্মে গিয়ে খুঁজে খুঁজে ২য় তলায় ফরেন কোটার টিকেট অফিসে গেলাম। দারুণ, আরামদায়ক সোফা আর এসির আরাম আছে সেখানে, সেটা দেখে টিকেট এর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সবার অরজিনাল পাসপোর্ট দেখেই তবে টিকেটের সঠিক তথ্য দিতে পারবে! তার মানে সবাইকে নিয়ে এখানে আসতে হবে। মোবাইলও নেই যে অন্যদের পাসপোর্ট নিয়ে আসতে বলবো, আমাদের তিন জনের পাসপোর্ট আমার কাছেই আছে।
আবারো ছুটতে হল প্লাটফর্ম ১ থেকে ১৬ তে। দুটো অটো নিয়ে সবাই মিলে অনেকটা ঘুরে চলে এলাম ১ নাম্বার প্লাটফর্মে। ব্যাগপত্র নিয়ে ফরেন কোটার অফিসে ঢুকতে ঢুকতে সাবই বিধ্বস্ত। নরম সোফা আর এসির আরমে বসে টিকেটের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মাত্র চারটা টিকেটই আছে, সেটাও টু টায়ারের, ভাড়া ৪২০০ রুপী করে! প্লেনের চেয়েও বেশী। তবুও ঝটপট কেটে নিলাম, যেহেতু আর কোন অপশন তখন নেই।
টিকেট কাটার পরে সবাই একটু নিশ্চিন্ত হলাম, এরপর রয়েছে হোটেল খুঁজে বের করার বিশাল ঝামেলার আর একটা কাজ। ওদেরকে ওখানেই বসিয়ে রেখে বের হলাম, যেহেতু দুটো পরিবার তাই যেমন তেমন হোটেল তো নেয়া যাবেনা, তাই অনেক খুঁজে খুঁজে দালালের চক্র থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে পেয়েছিলাম মোটামুটি রাত কাটানোর মত ভদ্রস্থ একটা হোটেলের দুটো রুম। তখন রাত ১১ টা। আবার প্লাটফর্মে গেলাম ওদেরকে নিয়ে আসতে।
শেষ হল একটি বিপর্যস্ত সন্ধ্যা আর বিধ্বস্ত রাত ও দিল্লীর দালাল থেকে নিস্তার পাবার গল্প।
শেষ কথা হল, দিল্লীতে ট্রেন টিকেট কাটার জন্য অবশ্যই আগে যাবেন ১ নাম্বার প্লাটফর্মে, যেটা ৭/২৪ (সাত দিন আর ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে) দালালের চক্করে না পরে আগে নিজ থেকে খোঁজ নিন, তারপর না হয় এজেন্ট বা দালালের ফাঁদে পা দেবেন। কারন ওরা টাকা নেবে, টিকেটও দেবে, কিন্তু সেটার হয়তো সিট নাম্বার থাকবেনা যেটা নিয়ে পরতে হবে নিদারুণ বিড়ম্বনায়। যেটা আমরা দুইবার পরেছিলাম! টিকেট ছিল, কিন্তু সিট ছিলোনা, তাও দিগুণ টাকা দিয়ে কাটা টিকেট!
তাই ভাই-বোনেরা যারা আসছে ছুটিতে ভারত যাবেন আর ট্রেন ভ্রমণের কথা ভাবছেন, পারলে টিকেট গুলো আগে করে রাখুন আর হাতে সময় নিয়ে রাখুন পর্যাপ্ত। আর খুব খুব আর খুব সাবধান! যে কোন যায়গায় থাকতে পারে…
দিল্লীর দালাল…!!
১৯ ডিসেম্বর ২০১৭
Post Copied From: