রোজ গার্ডেন,ঢাকা

কিভাবে যাওয়া যায়:
ঢাকার সদরঘাট, গুলিস্থান, মতিঝিল বা সায়দাবাদ হতে রিকশা বা সিএজিযোগে রোজ গার্ডেন যাওয়া যায়।
রোজ গার্ডেন পুরান ঢাকার টিকাটুলিস্থ কে এম দাস লেনের একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। তৎকালীন নব্য জমিদার ঋষিকেশ দাস বিশ শতকের তৃতীয় দশকে (সম্ভবত ১৯৩০ সালে) গড়ে তোলেন এ গার্ডেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে বলধার জমিদারের বাগান ও বাড়ি (যা বর্তমানে বলধা গার্ডেন নামে পরিচিত) উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ইতিহাস বলধার জমিদার নিজে নাট্যকার ছিলেন এবং তাঁর বাড়িতে নিয়মিত গান বাজনার আসর বসতো। ঢাকার একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে হৃষিকেশ দাস একদিন বলধার এক জলসায় গেলে সেখানে নিম্ন বর্ণের হওয়ায় তাঁকে অপমান করা হয়। এরই ফলশ্রুতিতে একই রকম বাগান ও বাড়ি নির্মাণ করে এর প্রতিশোধ নিতে তিনি দৃঢপ্রতিজ্ঞ হন বলে কাহিনী প্রচলিত আছে। এভাবেই নির্মিত হয় রোজ গার্ডেন। সমগ্র ভারতে অদ্বিতীয় গোলাপ বাগান সমৃদ্ধ বাড়ি হওয়ার কারনেই এর নাম হয় ‘বোজ গার্ডেন’। বেশীর ভাগ উপাত্ত থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৯৩০ সালের দিকেই হৃষিকেশ বাবু এ বাগান নির্মাণ শুরু করেন। এই বাগানের জন্য তিনি চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপের চারা এনে লাগিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে ঋণের দায়ে তিনি তাঁর সন্মানের প্রতীক এই জৌলুসপূর্ণ বাগানবাড়িটি ১৯৩৬ সালে খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের কাছে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হন। সত্তর সালের দিকে ‘রোজ গার্ডেন’ লীজ দেয়া হয় ‘বেঙ্গল স্টুডিও’কে। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ‘রোজ গার্ডেন’কে সংরক্ষিত ভবন বলে ঘোষণা করে। এরপর প্রথম হাত বদল হয় ১৯৩৭ সালে। ১৯৬৬ সালে আবদুর রশীদের বড় ভাই কাজী হুমায়ুন বশীর এই রোজ গার্ডেনের মালিকানা লাভ করেন। এ সময় তাঁর নামেই রোজ গার্ডেন হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কাজী হুমায়ুন ১৯৭০ সালে ।ততকালীন স্বনামধন্য চলচিত্র উন্নয়ন সংস্থা বেঙ্গল ষ্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লি: এর কাছে বাড়িটি ভাড়া দেন। শেষে ১৯৯৩ সালে বাড়িটির অধিকার ফিরে পান কাজী রকিব, হুমায়ুন সাহেবের পারিবারিক বংশধর। বাড়িটির বর্তমান মালিক তিনি ও তাঁর স্ত্রী লায়লা রাকিব।

স্থাপত্যিক আশ্চর্য ‘রোজ গার্ডেন’। হৃষিকেশ বাবু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্লভ সব গোলাপ গাছে সুশোভিত করেছিলেন এ বাগান। পুরো এলাকা সাজিয়েছিলেন ইউরোপীয় ঢঙে। ভবনটির অবাক করা নির্মাণশৈলী আর মুগ্ধ করা নকশা সবার মন কাড়ে। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন হিন্দু সমাজের উচ্চবিত্ত ও জমিদারদের আড্ডা জমতে থাকে রোজ গার্ডেনকে ঘিরে। সে সময় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ঋষিকেশ ও রোজ গার্ডেনের নাম। তখন বহু উৎসুক জনতা রোজ গার্ডেন দেখতে আসতেন। এখানেই গড়ে ওঠে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ।

দর্শনীয় অংশ রোজ গার্ডেনের পশ্চিম বাহু এবং উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ন খোলা প্রাঙ্গন। এখানে মঞ্চের উপর দন্ডায়মান আছে কয়েকটি সুদৃশ্য নারী মূর্তি। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তাকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি একটি করে বাধানো পাকা ঘাট আছে। এর পূর্বাংশে আছে পশ্চিমমূখী একটি দোতলা ইমারত। এ ইমারতটির নাম হলো “রশিদ মঞ্জিল”। রশিদ মঞ্জিলের প্রবেশপথের অনতিদূরের সম্মুখের চত্বরে ইটও সিমেন্ট নির্মিত একটি সুন্দর ফোয়ারা দেখা যায়। একটি সাত ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে রশিদ মঞ্জিলের প্রথম তলায় আরোহন করা যায়। এর সামনের দিকের মাঝামাঝি অংশের প্রতি কোঠার পাশাপাশি তিনটি খিলান দরজা আছে। উপরের তলায় প্রতিটি খিলানের উপর একটি করে পডিয়াম আছে। ‌টিমপেনামগুলো লতাপাতার নকশা এবং রঙ্গিন কাঁচ দিয়ে শোভিত। এর সামনে আছে বাইরের দিকে উপবৃত্তাকার উদগত অপ্রশস্ত বেলকনি। এর দুপাশে একটি করে করিনথীয় পিলার আছে। পিলারগুলোর দুই পাশের অংশে প্রতি তলায় আছে একটি করে খিলাল দরজা। এদের প্রতিটির কাঠের পাল্লার ভনিসীর ব্লাইন্ড ও টিমপেনামে লতাপাতার নকশা দেখা যায়। এবং সামনেই অপ্রশস্ত খোলা বেলকনি আছে। এর উপরাংশের কার্ণিস বক্রাকার যা বেলস্ট্রেড নকশা শোভিত। অপরাপর অংশের কার্ণিসগুলোও একই রকম। মধ্যবর্তী অংশ ছাদের সামনের ভাগে আছে আট কোনাকার এবং খিলান সম্বলিত বড় আকারের ছত্রী। এর ছাদ একটি আধাগোলাকার গম্ভুজ ঢাকা। ইমারতটির দু-কোনে দুটি করিনথীয় পিলার দেখা যায়। এদের শীর্ষেও ছত্রী নকশা আছে। এলাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত রশিদ মঞ্জিলের প্রতি তলায় মোট ১৩ টি ছোট ও বড় আকারের কোঠা আছে। প্রথম তলায় প্রবেশের পর পশ্চিমাংশের বাঁ দিকে আছে উপরের তলায় যাওয়রা জন্য ঘুর্ণায়মান সিঁড়ি। এ ইমারতের পূর্ব বাহুর বাম পাশে আছে দুই বাহু বিশিষ্ট আর একটি দোতালা ইমারত। ডান পাশে পরবর্তীকালে আরও কিছু ইমারত নির্মিত হয়েছে। বাইরে ও ভেতরের দিকে পুরোপুরি চুনকামসহ গতরলেপনে আবৃত এ ইমারতের খিলানের টিমপেনামের রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করণ বেশ আকর্ষণীয়।

বর্তমান অবস্থা ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন বর্তমানে নাটক ও টেলিফিল্ম শ্যুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সত্তরের দশকের জনপ্রিয় ছবি মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চিত্রায়িত হয়েছিল এ বাড়িতে। শবনম, রহমান ও গোলাম মোস্তফা প্রমুখ ছবির পাত্র-পাত্রী। পরে এ ভবনে আরো অনেক ছবির চিত্রায়ণ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য এখন বিভিন্ন নাটক ও টেলিফিল্মেওও অবলোকন করা যায়।

অবস্থান:
রোজ গার্ডেন পুরান ঢাকার টিকাটুলিস্থ কে এম দাস লেনের একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন।

Post Copied From:Rakibul Islam Rakib‎>Travelers of Bangladesh (ToB)