সাজেক ভ্যালি , পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু একটি পর্বত চূড়া। সাজেক নামকরণটি করা হয়েছে মূলত রাঙ্গামাটি জেলার বাগাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়নের নামে। তবে খাগড়াছড়ি থেকে এর যাতায়ত ব্যবস্থা সহজ। সাজেকের মূল পাহাড়ের আশেপাশের পাহাড় গুলোর গড় উচ্চতা এটি হতে প্রায় ৫০০ হতে ৭০০ ফুট কম, যেটি সাজেককে দিয়েছে অনন্যতা।
শুক্রবার সকালে যখন চাঁন্দের গাড়িতে( যদি ও আমাদেরটা ইন্ডিয়ান বলেরো ছিল) করে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিই, তখন সাজেকের একটি ছবি মনে মধ্যে এঁকে রেখেছিলাম, যার সাথে অনেকটা মিল পেয়েছি। খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর বাঘাইহাট নামক জায়গায় সাজেকমুখী সকল গাড়িকে থামতে হয়, যেখান থেকে সেনা বাহিনী সকল গাড়িকে escort দিয়ে নিয়ে যায়। বাঘাইহাট ও সাজেক উভয় দিক থেকে সকাল১০.৩০ টা ও বিকাল ০৩.৩০ টার সময় দুইটি escort ছাড়ে।
বাঘাইহাট থেকে যখন আমাদের গাড়ি সাজেকের দিকে যাচ্ছিল, তখন ছোট বড় অনেক পাহাড় ডিঙিয়ে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ভ্রমণ সত্যি রোমাঞ্চকর ছিল। সাজেকের খুব কাছে- যেখান থেকে সাজেক দেখা যাচ্ছিল, আমাদের গাড়ির এক চাকায় সমস্যা দেখা দেয়, যেটি আমাদের একটি পাহাড়ি পরিবারের সাথে এক ঘন্টা থাকার সুযোগ করে দেয়। পাহাড়ি পরিবারটি ঘর জসিম উদ্দিনের আসমানী বা শরৎচন্দ্রের গফুরের ঘরকে ও হার মানায়। ১০০ স্কয়ার ফুটের একটি ঘরে কমপক্ষে ১২ জনের বসবাস। তার মধ্যে বাচ্চা আছে ৬ জন, যাদের প্রত্যেকের বয়সের ব্যবধান সর্বোচ্চ ১ বছর। বন্ধু আমজাদ কে জিজ্ঞেস করলাম-কাহিনী কি? তার বুদ্ধি দৃপ্ত উত্তর, এন্টারটেইনমেন্টের জায়গা তো ঐ একটায়।
পার্বত্য এই মানুষ গুলো সত্যি যুগে যুগে বঞ্চিত। আশির দশকের শুরুতে যখন স্বৈরশাসকেরা নদী সিকিস্তি, নদী পয়স্তি মানুষেদের এক প্রকার জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলমেন্ট করেছিল, তখন কি তারা ক্ষীণকায় ভেবেছিল সীদ্ধান্ত কতটা আত্নঘাতী হবে? এখনো পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তের জের টান তে হচ্ছে পাহাড়ি বাঙ্গালী উভয়কে। পাহাড়ে শান্তি আজ সুদূর পরাহত। ৯৭ এর শান্তি চুক্তি তখনকার প্রেক্ষিত সময়ের দাবী মনে হলে, পাহাড়ে দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি স্থাপনে এটি যে একমাত্র অনুসঙ্গ নয় তা আজ দিবালোকের মত বাস্তব।
পুরো সাজেক ভ্রমনে সেনাবাহিনীর আচরণ দেখে সত্যি বিস্মিত হয়েছি। এ যেন ক্ষেপা বাঘের দাবড়ানি খাওয়া হরিনের আচরণের মত। হরিণ যেমন বাঘের সাথে না পেরে এমন জায়গায় লুকায় যেখানে তার মাথাটা ডাকা থাকে, বাকি শরির বাহিরে। সে ভাবে সে যেহেতু কাউকে দেখছে না, বাঘ মামা তাকে দেখছে না। যেটি তাকে বাঘের প্রাতরাশ হতে আরো বেশি সুযোগ করে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পৌর এলাকা, পর্যটন কেন্দ্র ও সেনাদের ক্যাম্প গুলো সুরক্ষিত। বাকি এলাকা ইউপিডিএফ ও জেএসএস যুদ্ধাদের হাতে। গেরিলা নীতিতে যুদ্ধ করা একটি শক্তির সাথে জেতা যে খুবেই কঠিন বা আধো সম্ভব নয়, তা তো ৭১ এ প্রমাণিত।
একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে কখনো বন্দুকের কার্তুজে দমন করা যায় না। পাহাড়িদের বঞ্চনা যত দিন শেষ হবে না তত দিন এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। যে পাহাড়ি মা টি প্রতিদিন দেখছে সিল্কি চুল উড়িয়ে, বুকে DSLR ক্যামরা ঝুলিয়ে একদল তরুণ তরুণীর সুখে গা ভাসানোর দৃশ্য, সে মায়ের মনে একবার হলো ও প্রশ্ন জাগবে না-আমাদের কি দোষ? আধরা সুখের অন্বেষনে সে যখন লিপ্সু হবে, তখনি তার কাছে বঞ্চনার জায়গাটা স্পষ্ট হবে। যখনি দেখবে এর জন্য এ সমাজ, রাষ্ট্র দায়ী, তখন সে তার সন্তানকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাড় করাতে কুণ্ঠিত হবে না।
সাজেকেই ফিরে আসি। যখন পৌঁছায়, তখন দিনের দুটা। যাওয়ার পর দেখি রুমের বন্দবস্ত হয়েছে ০৬ জনের অথচ আমরা মানুষ ১১ জন। এদিকে হোটেল মালিক বেঁকে বসছে-০৬ জনের রুমে ১১ জন থাকা যাবে না। অনেক কষ্টে তাকে ম্যানেজ করা গেল। ক্ষুদার্ত পেটে দুপুরের খাবারটা ভাল হয়েছিল সে দিন। বিশ্রামের সুযোগ নেই, বের হয়ে পড়লাম সাজেক দেখতে। মূল পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে কংলাক পাহাড় নামে আরো একটি পাহাড়, যার উচ্চতা সাজেক থেকে ৩০০ ফুট বেশি। যখন আমরা কংলাকের চূড়ায় তখন মৃদু শ্বাস কষ্ট অনুভব করলাম।
দুই দিনের বন্ধ থাকায় সে দিন প্রচুর পর্যটক ভীড় করেছিল সাজেকে। কিন্তু এক জন ও বিদেশী পর্যটক দেখলাম না। তবে মোট পর্যটকের ৩০% মেয়ে ছিল। এটি প্রমান দেয়- ইন্টানেটের কল্যানে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি বঙ্গদেশীদের আকর্ষণ বাড়লে ও বিদেশীরা একে এখনো নিরাপদ মনে করে না। অনেকে তো মানে করে এখানে সিভিল ওয়ার চলছে।
যখন ফিরছিলাম তখন সাজেকের জন্য সত্যি খারাপ লাগছিল। ফিরার পথে সাজেক মুখী যাদের দেখছিলাম তাদের সাথে আবার চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। ফিরতি পথে একটি পাহাড়ি বাচ্চাকে জাতীয় পতাকা উড়াতে দেখলাম যদি ও সেদিন বিজয় দিবস ছিল। হয়ত ছেলেটি অবচেতন মনে এটি করেছে। তবু ও এতটুকু বয়সে সে চিনেছে- এটি আমাদের জাতীয় পতাকা। ব্যাপারটা সত্যি ভাল লেগেছিল।
খাগড়াছড়ি এসে রোচাং ঝর্ণা, আলুটিলা, জেলা পরিষদ ঝুলন্ত ব্রিজ ও লেক দেখার সু্যোগ হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই তিনটি স্পটে সাজেকের সেই পরিচিত মুখ গুলোর সাথে বার বার দেখা হয়েছে। অর্থাৎ খাগড়াছড়ি ট্যুর টা সবাই পুরো প্যাকেজ আকারে নিয়েছে।
পরিশেষে যাদের পরিশ্রমে পুরো ট্যুরের ব্যবস্থাপনা সঠিক ছিল-বিশেষ করে বন্ধু আমজাদ, রানা ভাই, রায়হান প্রতি অনেক অনেক ভালবাসা। অপেক্ষায় আছি, আবার হারিয়ে যাব, কোন এক লোকালয়ে।
Post Copied From:Mohammed Sohel>Travelers of Bangladesh (ToB)