ঈদ এর ছুটিতে শ্যামলী’র টিকেট(১৫০০ টাকা শিলিগুড়ি পর্যন্ত) না পেয়ে ৫ জন মিলে মানিক পরিবহন এ রওনা দিলাম (এসি ৯০০ টাকা বুড়িমারী পর্যন্ত)| গন্তব্য লাভা, রিশপ, কালিম্পঙ| রাত ৯টায় গাড়ি ছেড়ে ভোর ৬টায় বুড়িমারী পৌঁছে বাস কাউন্টার এর লোকদের হাত এ পাসপোর্ট আর ১০০ টাকা ( ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা ঢাকা থেকে দিয়ে এসেছিলাম) দিলাম বর্ডার প্রসেস এবং সিরিয়াল দেওয়ার জন্য|
সকাল ৯টায় বর্ডার ওপেন হলে শুরু হলো লাইন এ দাঁড়ানো| ঈদ এর ছুটিতে প্রচন্ড ভিড় থাকায় ২ বর্ডার এর কাজ(২00 টাকা ঘুষ সহ) শেষ করতে দুপুর ১টা(এমনিতে ১০:৩০-১১:০০ বাজে| চেঙড়াবান্দাতে ডলার ভাঙিয়ে লাঞ্চ করলাম (ভাত, ডাল, রুই মাছ, সবজি, পাঁপড় ১০০ রুপি)| প্ল্যান ছিল ঐদিনই শিলিগুড়ি হয়ে লাভা যাবো কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় সে আশায় গুড়ে বালি কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে চেঙড়াবান্দা থেকে ময়নাগুড়ি হয়ে সেদিনই আমাদের লাভা পৌঁছে দিতে রাজি হলো একজন টাটা সুমো ড্রাইভার (৩৫০০ রুপি ভাড়া)| ছু মন্তর ছু রওনা দিয়ে দিলাম…..ময়নাগুড়ি ফরেস্ট রেঞ্জ , টি এস্টেট এর ভেতর দিয়ে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি কে পাশ কাটিয়ে ৮০ কিমি যাওয়ার পর শুরু হলো পাহাড়ে চড়া| অকল্পনীয় সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে জান হাতে আর বৃষ্টি, মেঘ, কুয়াশা মাথায় নিয়ে ৩৫ কিমি উপরে উঠলাম মাঝে বিরতিতে চা আর লেস চিপস খেলাম (৩৫ রুপি)| প্রায় ৮০০০ ফিট উচ্চতায় লাভা পৌছালাম রাত ৮টায়| ছোট্ট পাহাড়ি শহর হওয়ায় পুরা শহর তখন ঘুম| পাইন বন এ ঘেরা ছোট্ট শহর, পাশে পাহাড় চূড়ায় বিশাল বৌদ্ধ মন্দির, মেঘ এর চাদর এ ঢেকে আছে পুরো শহর| এত নীরব..!! এত শান্তি..!! হোটেল হিমালয় এ উঠলাম ৫ জন একটা রুম নিয়ে (১০০০ রুপি রুম ভাড়া)| বাঙালি হোটেলওয়ালা আমাদের রাত এ খাওয়ার অফার করলো (মুরগি, ডাল, ভাত, সবজি, আচার ১২০ রুপি)| আমরা উনাকে রান্না করতে বলে ঘুমন্ত শহর এ হাটতে বেরোলাম| নেপালি একটা দোকান খোলা পেয়ে ভেজ মোমো (৩০ রুপি), ভেজ সূপ(ফ্রি), চা (১০ রুপি) খেয়ে যখন একটা উঁচু পাহাড় এর মাথায় উঠে বসলাম তখন প্রচন্ড অবাক হলাম এ কোথায় এলাম..!! নিচে পাইন বন পূর্ণিমা চাঁদ এর আলোয় ভেসে যাচ্ছে| সব মেঘেরা আমার পায়ের নিচে ঢেউ খেলছে| পাশে বিশাল উঁচু একটা পাহাড় পুরাটা মেঘ এ জড়ানো, তার গায়ে পূর্ণিমার আলো প্রতিফলন হচ্ছে, পাহাড়টা যেন জ্বলছে …এটাই তাহলে চাঁদের পাহাড়..!! সারা জীবন গল্প উপন্যাসে পরে যা কল্পনা করেছি এ তো তার চেয়েও সুন্দর| কি সুন্দর..!! কি সুন্দর সে চাঁদের পাহাড়..!!
পর দিন ভোর এ উঠে লাভা টাউন, বৌদ্ধ মন্দির, সুইসাইড পয়েন্ট, রাচেলা পয়েন্ট (ফ্রি লিফ্ট পেয়েছিলাম একজন এর স্ক্যুটি তে)ঘুরে ব্রেকফাস্ট করলাম ( সমুচা আর চা ২০ রুপি, মোমো ৪০ রুপি)| শহরের প্রতিটি মানুষ অনেক শান্তি প্রিয়, হেল্পফুল আর হাসি খুশি| তারপর হোটেল ছেড়ে সুমো স্ট্যান্ড এ এসে সুমো ভাড়া করলাম রিশপ, নেওরা ভ্যালি পাইন ফরেস্ট হয়ে ডেল রিসোর্ট ঘুরে কালিম্পঙ টাউন এ রেখে আসবে আমাদের (২৪০০ রুপি)| শুরু হলো আরো উপরে ওঠা এবড়ো থেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে| কখনো পাহাড়ি ভেজা রাস্তা কখনো ঘন অন্ধকার পাইন ফরেস্ট এর ভেতর দিয়ে ১ ঘন্টা যাওয়ার পর পৌছালাম ৮৫০০ ফিট উচ্চতায় রিশপ নেওরা ভ্যালিতে| অসাধারণ সুন্দর লেপ্চা কটেজ, স্কটিশ কটেজ এ ভরা নেওরা ভ্যালি রিসোর্ট থেকে হেটে নেওরা ভ্যালি পাইন ফরেস্ট এ ঢুকলাম. বৃষ্টি ভেজা, মেঘ এ ঢাকা, অন্ধকার রহস্যময় বন. বিশাল বিশাল পাইন গাছের সারি, পাখির ডাক. অদ্ভুত এক ঠান্ডা গা ছমছম পরিবেশ| বন এর ভেতর দিয়ে মেঘ এর নদী বয়ে চলেছে| পুরা পরাবাস্তব পরিবেশ| সে পরিবেশ থেকে বের হয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম, গন্তব্য ডেল রিসোর্ট| পথে ২বার চা খেলাম আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম|
ডেল রিসোর্ট হলো পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ এ ঢাকা বিশাল অভিজাত রিসোর্ট (এন্ট্রি ফী ২০ রুপি, পার্কিং ফী ২০ রুপি) রিসোর্ট এর ভিউ পয়েন্ট থেকে পাহাড়, তিস্তা নদী আর বন এর ভিউ চমৎকার, প্যারাগ্লাইডিং করা যায় এখানে (৩০০০ আর ৭০০০ রুপি প্যাকেজ) সেখান থেকে পাহাড়ি তিস্তা নদী ধরে আমরা কালিম্পঙ এলাম বিকেলে| পুরোনো বনেদি একটা সুন্দর শহর| ব্রিটিশদের ছাপ এখনো স্পষ্ট| বাংগালী মাসিমার হোটেল এ খেয়ে নিলাম (ভাত, ডাল, কাতল মাছ, ভর্তা, সবজি, আচার, আলু ভাজি ১৫০ রুপি)| শহরটা একটু ঘুরে দেখে সন্ধ্যায় রওনা দিলাম দার্জিলিং এর উদ্দেশে (শেয়ার্ড সুমো, পার পারসন ১৫০ রুপি) রাত ৮টা নাগাদ এলাম বিখ্যাত দার্জিলিং এ| উঠলাম হোটেল সাগরিকাতে (৫ জন একরুম ২০০০ রুপি) এর আগের দার্জিলিং ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা (অন্য গল্পে বিস্তারিত) থেকে গেলাম হোটেল ইসলামিয়াতে রাত এর খাবার খেতে (গরু’র গোস্ত ভুনা দিয়ে পরোটা আর কাচ্চি বিরিয়ানি, ১৫০-২০০ রুপি) তারপর মল চত্বর এ কিছুক্ষন থেকে এক কাপ স্পেশাল দার্জিলিং চা খেয়ে ঘুম|
যেহেতু এর আগেও দার্জিলিং ঘুরেছি (অন্য গল্পে বিস্তারিত) তাই ইচ্ছে ছিল বাহিরে কোথাও না যেয়ে সারাদিন দার্জিলিং শহরের অলিগলি তে হাটবো, বিখ্যাত ইন্ডিয়ান, তিব্বতি, নেপালি, ব্রিটিশ রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাবো আর আরাম করে পাহাড়ের চূড়ায় কোথাও বসে পাহাড় আর মেঘ দেখবো| তাই করলাম, নিচের ছবিটি এমন এ একটা জায়গায় বসে উঠানো (মল চত্বর)|
বিকেলে দার্জিলিং থেকে শেয়ার্ড সুমোতে করে শিলিগুড়ি চলে এলাম(১৫০ রুপি)| সন্ধ্যায় উঠলাম হোটেল মাউন্ট ভিউ এ (পার রুম ৮০০ রুপি, ৩ জন)| রাত এ বিধান মার্কেট, সেভক রোড আর হিল কার্ট রোড এ ঘুরে ফিরে রাত এ খেলাম বিখ্যাত খানা খাজনা তে (হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি ১৩০ রুপি, কুলফি আইস ক্রিম ৮০ রুপি)|
পরদিন সকালে নাস্তা করে (পরোটা ডিম্ ভাজি, চা ৫০ রুপি) বাস এ করে শহর এ একটু ঘুরলাম তারপর চেংড়াবান্দা আসার জন্য টাটা ইন্ডিগো গাড়ি ভাড়া করলাম (১১০০ রুপি, ৪ জন বসতে পারবে)| বাস ও আসে (৫০ রুপি) কিন্তু আমরা একটু আরাম এ আসতে চেয়েছিলাম| প্রায় ৮০ কিমি পথ পেরিয়ে বর্ডার এ এলাম দুপুর ১টায়, বর্ডার এর ঝামেলা শেষ করে প্রাণ এর দেশে ফিরলাম বিকেল ৩টায়| এরপর বিশাল এক এডভেঞ্চার করে বুড়িমারী- পাটগ্রাম- লালমনিরহাট- রংপুর হয়ে ঢাকা এলাম পরদিন সকাল ১০টায়|
সর্বমোট খরচ প্রতিজন ৮০০০ টাকা ( ভিসা খরচ এবং ডলার এন্ডোর্স খরচ বাদে)
Post Copied From:Shadman Mahbub>Travelers of Bangladesh (ToB)