আন্দামানের ছোঁয়া

কোলকাতা থেকে দুই ঘন্টা পনের মিনিটের বিমান যাত্রায় তেরশ কিমি পাড়ি দিয়ে আন্দামান ও নিকোবর রাজ্যের রাজধানী পোর্টব্লেয়ার পৌছালাম। আকাশ থেকে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে দেখছি সাগর আর পাহাড়ের মিতালি , আন্দামানের চার পাশে বঙ্গোপসাগর , আন্দামান সাগর আর ভারত মহাসাগরের অবস্থান। আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ড এর একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর -বীর সাভারকার বিমানবন্দর , ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম। বলে রাখা ভালো যে আন্দামানে প্রবেশের জন্য সব বিদেশিদেরই বিশেষ অনুমতি (RAP -রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া পারমিশন) নিতে হয়, যা খুবই অল্প সময়ে নিদৃষ্ট কাউন্টার এ ফর্ম পূরণ করে পাওয়া যায়।

এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল এ চেক ইন আর লাঞ্চ করেই ছুটলাম সেলুলার জেল এর উদ্দেশ্যে যা আমাদের ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। ব্রিটিশ শাসনের নির্মম সাক্ষী কালাপানি নামে পরিচিত এই সেলুলার জেল যা দীপান্তরিত হাজার হাজার বন্দীদের দিয়ে দীর্ঘ দশ (১৮৯৬-১৯০৬) বছরে নির্মাণ করা হয়েছিল। সাইকেলের চাকার আদলে তৈরি এই স্থাপনায় সাতটি উইংস এ মোট ৬৯৬ সেল , ওয়াচ টাওয়ার , কনডেম সেল ,ফাঁসিকাষ্ঠ ও আনুষাঙ্গিক স্থাপনা আছে। প্রতিদিন (সরকারি বন্ধ বাদে) সন্ধ্যা থেকে এর খোলা চত্বরে লাইট এন্ড সাউন্ড শো এর মাধ্যমে এই Unesco হেরিটেজের পুরো বিবরণ তুলে ধরা হয়। এই ধারাভাষ্যে ফুটে উঠে রাজবন্দীদের জীবন,মুক্তিসংগ্রাম ও ব্রিটিশ শাসকের নির্মমতা। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে এই জেলে রক্ষিত রাজবন্দীদের তালিকার অধিকাংশই তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষ যা প্রমান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের অগ্রণী ভূমিকার কথা।

পরদিন সকালে আমরা গেলাম রস আইল্যান্ড যেখানে এই জেলের ব্যাবস্থাপনার সাথে জড়িত ব্রিটিশ অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গের বিলাসী জীবন যাপন সম্মন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। রস এটি একটি ছোট্ট দ্বীপ যা মোটর বোট এ মাত্র দশ মিনিটে যাওয়া যায়।প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য ও উন্নত জীবনযাপনের ব্যাবস্থাপনার জন্য এই দ্বীপ তখন প্যারিস অফ ইস্ট নামে পরিচিত ছিল যা এখনো দৃশ্যমান সুইমিং পুল , পানি শোধনাগার , ডিজেল জেনারেটার , ছাপাখানা ,চিত্রশালা , চার্চ, বেকারি , উন্মুক্ত মঞ্চ ও ক্লাব দেখে অনেকখানি অনুধাবন করা যায়।

দুই রাত তিন দিনের ইতিহাস ঘাটাঘাটি শেষে এবার নির্ভেজাল প্রকৃতির সন্ধানে আমরা রওনা দেই আন্দামান সাগরের দ্বীপ হাভেলকের উদ্দেশ্যে। ৮০ কিলোমিটার সমুদ্র্রপথ আধুনিক cruise শিপ এর কল্যানে মাত্র দুই ঘন্টার যাত্রা। জাহাজ থেকে নেমে দীর্ঘ জেটির পথ বিস্ময়ে ভরপুর -নিচে স্বচ্ছ পানি আর সাদা বালিতে রং বেরং এর অগণিত মাছের মেলা। এখানেও সময় বাঁচাতে হোটেলে চেক ইন আর লাঞ্চ করে আবার ও এক ঘন্টার ট্যাক্সি জার্নি শেষে রাধানগর বিচ -টাইম ম্যাগাজিন এর বিচারে এশিয়ার সেরা। আসলেই দেখবার মতো-নীল পানি,সাদা বালি আর ঘন বনের মিতালী। পরদিন সকালের গন্তব্য এলিফ্যান্ট বিচ , যেখানে অনিন্দসুন্দর বিচ এ মাঝে মাঝেই হাতির দেখা মেলে। নানারকম ওয়াটার স্পোর্টস এর সাথে ঠিক শেষ মুহূর্তে হাতির দেখা আমাদের ভ্রমণ কেও পরিপূর্ণ করে।

দুইরাতের হাভেলক ভ্রমণ শেষে আবারও শিপে নীল আইল্যান্ড -এবারের যাত্রা ৪৫ মিনিটের। এই দ্বীপ বিখ্যাত তার জীবন্ত প্রবালের জন্য -মাত্র দুই ঘন্টার গ্লাস বটম বোট এ স্বচ্ছ পানিতে জীবন্ত প্রবাল আর মাছের লুকোচুরি সারাজীবন মনে রাখবার মতো স্মৃতি। এই দ্বীপেই আছে কোরাল ব্রিজ যা স্থানীয়ভাবে হাওড়া ব্রিজ নামে পরিচিত। প্রায় ছয়শত দ্বীপ নিয়ে আন্দামান এন্ড নিকোবর আইল্যান্ড যার মাত্র ২৫/২৬ টি তে মানুষের (আদিবাসী সহ ) বসতি রয়েছে। আমাদের পাঁচ রাত ছয় দিনের ভ্রমণে তার মাত্র চারটি দ্বীপ দেখা সম্ভব হয়েছে। দ্বীপের প্রায় চার লাখ অদিবাসীর অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী -যাদের পূর্বপুরুষ তৎকালীন পূর্ববাংলা (বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চল) থেকে যাওয়া। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনি সবাই তাদের বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ করেছেন , পরিবারের বয়োজোষ্ঠ সদস্যদের স্মৃতিচারণে বাংলাদেশের কথা বলেছেন এবং আমাদের দেশের উন্নতি সম্মন্ধে জানতে চেয়েছেন। এখানে লোকজন অনেক অতিথি পরায়ণ , প্রচুর হোটেল হয়েছে , খাবার একদমই বাংলাদেশের মতো -তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর আমাদের রাজনৌতিক ইতিহাসের সাক্ষী আন্দামান হতে পারে আপনার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য

Post Copied From:Shamim Hussain>Travelers of Bangladesh (ToB)