৫০ ডলারে দার্জিলিং (রিশপ-লাভা) ভ্রমণ
কিভাবে সেটা?
চলেন দেখে বা ঘুরে আসি মাত্র ৫০ ডলারে দার্জিলিং আসলে (রিশপ-লাভা) যা আমার চোখে দার্জিলিং এর চেয়েও শতগুণে সুন্দর, আকর্ষণীয় আর অভিজাত! তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে আসি, কি বলেন?
যাত্রা শুরু ঢাকা থেকে……
৬৫০ টাকায় নাবিল পরিবহনের ধূমপান যুক্ত ও প্রায় লোকাল গাড়িতে! করে সকাল ৭:৩০ এ পঞ্চগড়। প্রথমবার এই গাড়ি যথেষ্ট ভালো সার্ভিস দেয়াতে, দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করে নাবিলের টিকেট কেটেছিলাম। যার পরিণাম এইবার পেয়েছি হাতে-হাতে।
পঞ্চগড় থেকে দেড় ঘণ্টার সুপার লোকালে ৭০ টাকার বিনিময়ে বাংলাবান্ধা, মাঝে তেতুলিয়াতে ১০ টাকার লুচি আর চা, ব্যাস হয়ে গেল সকালের নাস্তা।
ফুলবাড়ি গিয়ে মাত্র ৫/৭ মিনিটে সব ফর্মালিটি শেষ করে, ১০ মিনিট হেটে মূল শহরের রাস্তায় গিয়ে, ২২ টাকা দিয়ে শিলিগুড়ি গেলাম পানির ট্যাংকি জীপ স্ট্যান্ডে। যেখান থেকে সরাসরি কালিম্পং ও লাভার শেয়ার জীপ পাওয়া যায়। পৌঁছে গেলাম ১৫/২০ মিনিটে সেই গন্ত্যব্যে। তখন বেলা ১১ টা।
গিয়ে জানলাম কালিম্পং এর জীপ এখনি যাচ্ছে, লাভার জীপ আছে তবে সেটা দুপুর ২ টার পরে। লাভা যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩:৩০ ঘণ্টা! আর সেই জীপও কালিম্পং হয়েই যাবে। তাই আর দেরী না করে কালিম্পং যাবার জীপের টিকেট কাটলাম, সাথে কিনে নিলাম পথে খাবার জন্য প্রায় ২০০ টাকার শুকনো খাবার। পথে যদি ভালো যায়গা না পাই তবে যেন লাঞ্চটাও সেরে ফেলা যায়, এমন কিছু খাবার সহ।
ঠিক ঠিক ২:৩০ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম কালিম্পং। মাঝের যে অপার্থিব প্রকৃতির সৌন্দর্য পেয়েছি সেজন্য আলাদা গল্প লেখা আছে “৩০ সেকেন্ড আর ৫০ টাকার” গল্পে, চাইলে পড়ে দেখবেন। এখানে শুধুই টাকার হিসেবের খতিয়ান, কারণ সবাই এটাই পড়তে চান! বাকি গল্পগুলো আমার নিজের টাইম লাইনের জন্য! আগ্রহ থাকলে ওখানে গিয়ে পড়ে নিয়েন!
কালিম্পং গিয়ে জীপ থেকে নাম্বার আগেই দেখি লাভার দিকে ছেড়ে যাচ্ছে আর একটি জীপ। ড্রাইভারকে জানাতেই তিনি লাভার জীপকে দার করালেন। এক জীপ থেকে নেমেই আর এক জীপে উঠে পড়তে গিয়েই দেখি, আরে এ যে অরণ্য আর মাধবী! “নো ম্যান্স ল্যান্ড!” ধারাবাহিকের আহা! মাধবীদের সাথে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি আর ঢেউ খেলানো পথে দুলতে-দুলতে, বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে আর শিহরিত হতে-হতে লাভায় পৌঁছে গেলাম ১:৩০ মিনিটে (এই ভীষণ রোম্যান্টিক গল্পটা “নো ম্যান্স ল্যান্ড” উপন্যাসের জন্য আমার টাইম লাইনে!) ভাড়া ছিল টাকায় ৭৮ টাকা মাত্র!
লাভায় গিয়ে দেখি সব বন্ধ, কিছুই খোলা নেই! না কোন হোটেল না কোন লজ, না কোন খাবার জায়গা! কারণ এখন পুরোপুরি অফ সিজন। তাই সবাই যে যার মত আছে, নিজেদের নিয়ে। পাহাড়েরও যেন কোনই কাজ নেই, নেই কোন পর্যটক, তাই সব পাহাড়েরা মিলে গল্প করছে খুব-খুব মন খারাপ নিয়ে, কারো মুখে হাসি নেই যেন, গাড় কালো মেঘে ঢেকে রেখেছে নিজেদেরকে কষ্টের আঁচল দিয়ে! কোন-কোন পাহাড় আবার করুন কণ্ঠে সূর তুলেছে ঝরিয়ে বৃষ্টির তান!
তবুও খুঁজে-খুঁজে একটি লজে থাকার ব্যাবস্থা করে ফেললাম, ভাড়া অফ সিজন বলে মাত্র ৩৬০ টাকা রুম প্রতি! যদিও ৪০০ টাকা চেয়েছিল, কিন্তু দরদাম করে এটাতেই রফা করেছিলাম। হিম শীতল পানিতে একটু ফ্রেস হয়ে গরম কাপড় পড়ে বাইরে বের হলাম, বৃষ্টি আর পাহাড় দেখতে একা-একা, ঘুরে-ঘুরে।
কোন খাবারের (লাঞ্চ এর জন্য) দোকান খোলা না পেয়ে শেষে নিজের কাছে রক্ষিত কেক-কোক আর চকলেট দিয়েই লাঞ্চ সারতে হয়েছিল। হাটতে হাটতে চলে গেলাম লাভার ভীষণ সুন্দর, ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন এক মনেসট্রিতে। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র পেয়ে গেলাম, যে ভ্যাকেশনে বাড়িতে এসেছে সময় কাটাতে। তার সাথে বৃষ্টির মাঝেই ঘুরে দেখলাম সেই জায়গাটার খুঁটিনাটি।
ভিউ পয়েন্ট, রাচেলা পিক, কাঞ্চন পিক, এমন আরও অনেক অনেক মজার তথ্যে আমাকে অভিভূত করে রেখেছিল সন্ধা নাম্বার পূর্ব পর্যন্ত। এরপর বৃষ্টির ছাট আর প্রায় সন্ধার আঁধারে দুজনে মিলে লাভার পিকে বসে উপভোগ করলাম গরম কফি! আহ সে এক অপার্থিব পাওয়া। (ভিন্ন গল্পে থাকবে সেই মজার সৃতি!)
সন্ধা নামতেই সব সুনসান। এমনিতেই মানুষ নাই, তখন তো আরও নাই। তাই রুমে ঢুঁকে দুই কম্বলের নিচে ঢুঁকে পড়লাম! হ্যাঁ এমনই ঠাণ্ডা যে মোটা মোটা দুই কম্বলেই সস্থি খুঁজে নিতে হয়েছে! তন্দ্রা লেগেছিল বেশ, সারাদিনের পাহাড়ি ঝাঁকুনিতে, ঝিমিয়ে পড়েছিলাম কানে হেডফোন লাগিয়ে। চমকে গেলাম, লজের কেয়ারটেকারের ডাকে। তিনি গরম গরম খাবার রেডি করে ডাকতে এসেছেন। ৯০ টাকায় ডিনারের প্যাকেজ! খেয়ে দেয়ে ঘুম।
সকাল ৫:১৫ তে ঘুম থেকে উঠে রিশপের পথে পায়ে হাটা শুরু, নেওরাভ্যালী ন্যাশনাল ফরেস্ট এর ভিতর দিয়ে, যে গল্পটা ইতিমধ্যেই পোস্ট করা হয়েছে (যাহ কুত্তা, কাম বয়েস!” নামে!) রিশপ পৌঁছে মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা! বুঝতে পারছিলাম না কোন দিকে তাকাবো, পূর্বে না পশ্চিমে, উত্তরে না দক্ষিণে? চারদিকে এতটাই মুগ্ধতা আর আকর্ষণের ছড়াছড়ি!
দুপুর পর্যন্ত রিশপে কাটিয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম। লাভায় ফিরে এসে, লাঞ্চ সেই ১০০ টাকার প্যাকেজ! সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে, এটা সেটা খেয়ে আরও ২৫ টাকা খরচ করে ফেললাম! ওহ সাথে কফির জন্যও ২০ টাকা! পরের দিন আবার ফেরার পালা। সেই একই ভাবে তবে এবার কেন যেন ৮৫ টাকা লাগলো, লাভা থেকে কালিম্পং যেতে! তবে কালিম্পং এসে লাভা থেকে ফেরার সেই অতিরিক্ত জীপ ভাড়ার টাকা পুষিয়ে নিয়েছিলাম, কালিম্পং থেকে ১৪৫ টাকার জীপে না ফিরে, পাবলিক বাসে ১২০ টাকা ভাড়া দিয়ে!
শিলিগুড়ি ফিরে ৫০ টাকার চাওমিন, ২৫ টাকার রসগোল্লা, ১৫ টাকার লিমকা খেয়ে আর ২০ টাকার আইসক্রিম নিয়ে উঠে পড়লাম ফুলবাড়ির অটোতে ভাড়া ১৮ টাকা। তারপর ফুলবাড়ি সীমান্তে অভাবনীয় আতিথিয়তা! (সে অন্য গল্পে)। এরপর আর কি? ৭০ টাকায় পঞ্চগড় আর ৬০০ টাকায় ধূমপানযুক্ত নাবিল পরিবহণে ঢাকা!
এই হল আমার দার্জিলিং জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় দুই যায়গা রিশপ-লাভা ভ্রমণের খরচের খতিয়ান। তো দেখে নেয়া যাক, সাকুল্যে কত খরচ হল?
- ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা ৬৫০+৭০= ৭২০/- টাকা
- ট্র্যাভেল ট্যাক্স-৫০০/- টাকাফুলবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি ২০/- টাকা
- দুই দিনের জন্য স্ন্যাক্স ১৭৫/- টাকা
- (২০০ টাকার স্ন্যাক্স এর কিছু বেঁচে গিয়েছিল যা পরে ফেরত নিয়ে এসেছি!)
- কোক ৫০/- টাকা
- শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং ১৫০/- টাকা
- কালিম্পং থেকে লাভা ৮৫/- টাকা
- সেদিন দুপুরে লাঞ্চ পাওয়া যায়নি লাভাতে! কাছে থাকা কেক আর কোক দিয়ে লাঞ্চ!
- প্রথম রাতের ডিনার ১১৫/- টাকা
- সকালে স্ন্যাক্স সাথে ছিল, কফি ১৫/- টাকা
- দুপুর আর রাতের লাঞ্চ-ডিনার ২৩০/- টাকা
- দুই রাতের লজ ভাড়া ৭২০/- টাকা
- সকালের নাস্তা কেনা ছিল, কফি ২০/ টাকা
- লাভা থেকে কালিম্পং ৯০/- টাকা
- কালিম্পং থেকে শিলিগুড়ি ১২০/- টাকা বাস ভাড়া।
- আরও ৫০ টাকা নিজের তিস্তায় নেমে গোসল করার জন্য অতিরিক্ত বাস ভাড়া।
- দুপুরের পরে শিলিগুড়ি ফিরে লাঞ্চ স্বরূপ ১৩৫/- টাকা (চাওমিন-মিষ্টি-লিমকা-আইসক্রিম)
- বাংলাবান্ধায় খাবার ৭০/- টাকা
- বাংলাবান্ধা থেকে পঞ্চগড় ৭০/- টাকা
- পঞ্চগড় থেকে ঢাকা ৬০০/- টাকা বাস ভাড়া
- মোট খরচ= ৩৯৩৫/- টাকা! (৪৯.১৮ ডলার!
সবাইকে ধন্যবাদ।
সবার ভ্রমণ সুন্দর আর আনন্দঘন হোক।
সেই প্রত্যাশায়………
কৃতজ্ঞতায়ঃ Sajol Zahid