অনেকের মত আমিও জানতাম ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী
গ্রীসে অবস্হিত। তুরস্কে এসে গল্পে গল্পে জানতে
পারলাম সেই বিখ্যাত হেলেনের ট্রয় তুরস্কে। সাথে
সাথে নেটে সার্চ দিলাম। সত্যিই তাই। আবার সেটা
দার্দানেলিস প্রনালীর পাশে। এত কাছে এসে ট্রয় না
দেখে চলে যাব সেটাতো হতেই পারে না। যদিও ট্রয়
সম্পর্কে আমার ধারনা একটা শহর, একটি ঘোড়া ও হেলেন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এটুকু বুঝেছি হেলেন খুব সুন্দরী ছিল। এমনি এমনি তো আর ট্রয় ধ্বংস হয় নাই। আবারো সব জান্তা গুগুলকে বললাম ভাই আমারে একটু ট্রয় সম্পর্কে জানাও। বলা মাত্র ৪.৫ জিবি স্পীডে সে বলতে লাগলো গ্রীক পুরানের তিন দেবী আফ্রোদিতি, এথেনা, হেরা, হেলেন ও তার বৃদ্ধ স্বামী মেনেলাউস, ট্রয়ের রাজা প্রীয়ম ও তার দুই ছেলে প্রেমিক প্যারিস ও যোদ্ধা হেক্টর এবং সেই বীর যোদ্ধা একিলিস, যার নাম অনুসারে মানুষের পায়ের প্রধান রগের নাম টেন্ডো একিলিস ইত্যাদি ইত্যাদি। যতই পড়ছি ততই মজা পাচ্ছি। আর তার সাথে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে দেখার আকাংখা। কিন্তু চাইলেইতো আর হবে না। একজন সংগী দরকার। তারচেয়েও বড় কথা তাকে আবার তার্কিশ ভাষা জানতে হবে। কারন এখানকার লোকের ইংরেজী জ্ঞান সেইরকম।
যাহোক অনেক চেস্টা-তদবির করে এক বাংলাদেশী
ছাত্রের খোঁজ পেলাম যে কি না ট্রয়ের কাছাকাছি
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ফোন নং ম্যানেজ করে তার সাথে যোগাযোগ করে তারিখ ঠিক করলাম। তার সাথে কথা বলে আরেকটা বিষয় জানতে পারলাম এই জায়গাটা শুধু ট্রয় নগরীর জন্য বিখ্যাত নয়। বরং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য পৃথিবী ব্যাপী এর পরিচিতি আছে। আর এখানকার সেই যুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে অনেক লোক এসেছিল যুদ্ধ করতে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন সেই দলে। যাহোক সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নেটের মাধ্যমে বাসের টিকেট কেটে ও হোটেল রিজার্ভেশন দিয়ে ছুটলাম ট্রয় জয়ের উদ্দেশ্যে।
রাত ১২ টায় আমার গাড়ী ছাড়বে চানাক্কেলের
উদ্দেশ্যে আংকারা বাসস্ট্যান্ড থেকে। একে
বাসস্ট্যান্ড না বলে বিমানবন্দর বললেই বেশী মানান সই হতো। আমাদের ঢাকা বিমানবন্দরের থেকে কোনো
অংশে কম নয়। ও বলায় তো হয় নাই ট্রয় নগরীর অবস্থান তুরস্কের এশিয়ান অংশে দার্দানেলিস প্রনালীর পাশে চানাক্কেলে নাম শহরের কাছে। সীটে বসে মনিটর অন করতেই দেখি আমার নাম, কোথায় উঠবো আর কোথায় নামবো সবই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। স্ক্রিনে নিজের নাম দেখে ভালই লাগলো। আর তার সাথে নিশ্চন্ত হলাম সঠিক বাসেই উঠেছি। বাস ছাড়লো ৩ মিনিট দেরীতে ১২:০৩ টায়। হেডফোন কানে লাগিয়ে অঞ্জন দত্তের গান ছাড়লাম। কারন যেতে হবে প্রায় ৭০০ কিঃমিঃ। প্রায় ১০ ঘন্টার জার্নি। এখানকার বাস ও রাস্তা দুটোই ভাল। মনে হয় একে অপরের জন্য তৈরী। তবে সিটগুলো আমাদের দেশের মত আরামদায়ক নয়। এর থেকেও বড় বিপদে পড়লাম। আমার পাশের সিটে যিনি বসেছেন, তিনি প্রচুর পানীয় খেয়ে পুরাই আউট। পাঁচ মিনিট না যেতেই দেখি আমাকে বালিশ বানিয়ে ফেলছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম
এতদুরের পথ। তবে বিধাতার সুদৃষ্টি থাকার কারনে হয়তো আমার পিছনে একটা সীট ফাকা ছিল। আর শেষ পর্যন্ত সেখানেই আশ্রয় নিলাম। আর ভয়ে ভয়ে আছি কখন কে চলে আসে। তবে পুরো পথটা ভালভাবেই পৌছালাম চানাক্কেলে বাসস্ট্যান্ডে এবং এখান থেকে ডলমুজ অর্থ্যাৎ মিনিবাসে করে হোটেলে পৌঁছালাম। হোটেলে ব্যাগ রেখেই ছুটলাম হেলেনের ট্রয়কে জয় করার লক্ষ্যে ২ জন বাংলাদেশী ছাত্র সৈকত ও সাদিককে সাথে নিয়ে। ওরা দুজনই এগ্রিকালাচারাল বায়োটেকনোলজিতে পড়ে। সেই সময়ের সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ট্রয় এখন মূলত একটি পুরাকীর্তির নাম। ট্রয় সম্পর্কে মানুষ প্রথম জানতে পারে গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি
থেকে। ১৮৭০ সালে জার্মান আর্কিওলজিস্ট Heirich
Schliemann কর্তৃক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সকলে মনে করতো ট্রয়ের গল্পকথা একটা মিথ। তারপর অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত হয় এটাই সেই ঐতিহাসিক ট্রয় নগরী। ট্রয় নগরী বর্তমান তুরস্কের চানাক্কেলে প্রদেশের Hisarlik নামক জায়গায় দার্দানেলিস প্রনালী ও এজিয়ন সাগরের পাশে অবস্হিত। তার এই অবস্থানের কারনে অর্থাৎ ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী হওয়ার কারনে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক উন্নত ছিল। তুরস্কে ট্রয়কে Truva বলে। এই সমৃদ্ধশালী নগরী শুধুমাত্র হেলেনের কারনে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়, ব্যাপারটা এত সরল না। খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ অর্থাৎ এখন থেকে ৫০০০ বছর আগে থেকে শুরু করে রোমান সম্রাজ্য পর্যন্ত অনেকবার এই নগরী তৈরী ও ধ্বংস হয়। এই তৈরী ও ধ্বংসের সময়কালকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। প্রথম ৫ টির গঠনকাল প্রাথমিক তাম্র যুগে, ৬ষ্ঠ ও ৭ম যাথাক্রমে মধ্য ও শেষ তাম্র যুগে এবং ৮ম ও ৯ম যাথাক্রমে হেলেনেস্টিক ও রোমানদের সময়ে। একদিকে তৈরী হয়। অন্যদিকে কোনো কোনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা আবার ধ্বংস হয়। এর মধ্যে ৭ম ট্রয়টা হেলেনের ট্রয় যা ট্রোজান যুদ্ধের কারনে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।। এতবার ধ্বংসের কারনে অনেকে বলে এটি একটি অভিসপ্ত জায়গা। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এখানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয় ও ৫ লাখের অধিক সৈন্যের প্রানহানী ঘটে।
যাহোক সুযোগ পেয়ে অনেক জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম। ট্রয় নগরী দর্শন করে অভিশপ্ত নগরীর মাটি ও পাথরের টুকরো নিয়ে গ্রীক বীর হেক্টরের সাজে কাঠের তৈরী ঘোড়ার সাথে ছবি তুলে দার্দানেলিস প্রনালীর সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে
চলে আসলাম চানাক্কেলে শহরে অবস্হিত ট্রোজান
ঘোড়ার স্ট্যাচুর কাছে। এই ঘোড়ার মুর্তিটি ২০০৪ সালে
ট্রয় সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় বানানো হয়েছিল। এখন
যা দার্দানেলিসের পাশে শোভা পাচ্ছে।
সবশেষে হেলেনের ট্রয়ের কাহিনীটা সংক্ষিপ্ত আকারে এরকম- স্পার্টার ( গ্রীস) রাজা বৃদ্ধ মেনেলাউসের স্ত্রী ছিল সে সময়ের সবচেয়ে সুন্দরী হেলেন। আর ট্রয় রাজ্যের রাজা প্রীয়মের দুই ছেলে হেক্টর ও প্যারিস। দুইভাই ব্যবসায়ীক কাজে স্পার্টা যায়। আর তখনই প্যারিস ও হেলেন উভয় উভয়ের প্রেমে পড়ে এবং ছোট ভাই প্যারিস, বড় ভাই হেক্টরকে না জানিয়েই হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে চলে আসে। তখন রাজা মেনেলাউস, তার ভাই আগামেনন ও মহাবীর একিলিস প্রায় ১০০০ জাহাজ নিয়ে ট্রয় আক্রমন করে। কিন্ত দুর্ভেদ্র দেওয়ালের কারনে ১০ বছর অবরোধ করেও ট্রয় নগরীর ভিতরে প্রবেশে ব্যর্থ হয় কাঠের তৈরী একটি ঘোড়ার মধ্যে বেশ কিছু সৈন্য রেখে পাশের একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। গ্রীকরা যুদ্ধ জয়ে ব্যর্থ হয়ে উপহার স্বরুপ এই ঘোড়া রেখে গেছে ভেবে ট্রয়ের লোকেরা ঘোড়াটাকে ভিতরে নিয়ে যায় এবং রাতের অন্ধকারে ঘোড়ার পেট থেকে গ্রীক সৈন্যরা বাহির হয়ে পুরো ট্রয় নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিনিত করে। এ যুদ্ধে গ্রীকবীর একিলিস, প্যারিস ও হেক্টর মৃত্যু বরন করে।
Post Copied From:Md Mizanur Rahman>Travelers of Bangladesh (ToB)