জাফলং বেড়াতে যায়নি এমন লোক বাংলাদেশে খুব কমই আছে। আমি গিয়েছি অসংখ্যবার। জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বলে আমি বারবার গিয়েও অতৃপ্ত থেকেছি। যখনি সুযোগ হয়েছে তখনি যেতে এতটুকু দ্বিধা করিনি। যদিও দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এখনো আমার দেখা হয়নি। বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, সেন্ট মারটিন যাই যাই করে এখনো যাইনি।
জানুয়ারি মাস। শীতের পুরো আমেজ চারিদিকে। কোথায় যাবো ভাবছি। হটাত সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর তলব। বললো, চার বছর পর বিনোদন ছুটি পেয়েছে। জাফলং যেতে চায়। আমার বাড়ী সিলেট আমাকে তার সাথে যেতেই হবে। শুধু যে যেতেই হবে তাও না, সব কিছুর ম্যানেজমেন্ট ও আমাকে করতে হবে। আমি অনুরোধটি লুফে নিলাম।
সকালে সকালে ফোন দিলাম জাফলং এর জৈনতা হিল রিসোর্টে। এক ভদ্র লোক লম্বা করে সালাম দিয়ে ফোন ধরলেন, বললেন, তিনি ওখানকার কেয়ারটেকার। আমি রুমের কথা জানতে চাইলে বললেন, মাত্র একটা ডাবল বেডেড রুম খালি আছে তাও যিনি সবচেয়ে আগে ডাচ বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে অনলাইনে আগে টাকা পাঠাতে পারবেন তিনিই বুকিং পাবেন। আমাকে ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিতে দিতে বললেন, অনেকেই ঐ রুমের জন্য তার সাথে কথা বলেছে কিন্তু এখনও পেমেন্ট করেনি বলে বুকিং কনফার্ম হয়নি।
আমি ছুটে গেলাম ডাচ বাংলা ব্যাংকের বিজয়নগর শাখায়। আমার অফিসের এর চেয়ে কাছে ঐ ব্যাংকের আর কোন শাখা নেই। কিন্তু বিধি বাম, এতো লম্বা লাইন যে আদৌ টাকা জমা দিতে পারবো কিনা এবং পারলেও বুকিং পাবো কিনা শঙ্কিত হয়ে গেলাম। যাই হোক, অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিলাম । আবার ফোন করলাম রিসোর্টে । ততক্ষণে টাকা জমা হওয়ার খবর পৌঁছে গেছে তার কাছেও। আমাদের দুই রাত থাকার সংস্থান হলো।
সেদিন শুক্রবার। ফজরের আজানের সাথে সাথেই আমরা রওয়ানা দিলাম। তখনো আলো আধারির খেলা, রাস্তা ঘাট ফাঁকা। আমরা টঙ্গি ষ্টেশন রোড দিয়ে উঠে গেলাম কালিগঞ্জ ভৈরব সড়কে। এই রাস্তায় সকাল সকাল রওয়ানা দেয়ার সুবিধা হলো যানজট এড়িয়ে দ্রুত ভৈরব পৌঁছে যাওয়া যায়। আমরা ভৈরব ব্রিজ পেরিয়ে সিলেট রোডে উঠে গেলাম ঘনটা দেড়েকের মধ্যে। এর মধ্যে নাস্তা সেরে নিলাম উজান ভাটিতে। সিলেটের পথে এটাই ভালো রেস্তোরা।
তারপর সিলেট রোডে গাড়ী ছুটছে। এই রোডে গাড়ী চালানোর মজাই আলাদা। ১৫০০ সি সির টয়োটা করোল্লা , যেন সুপারিসর রানওয়ে তে দৌড়চ্ছে , যে কোন সময় টেক অফ করবে। দুইপাশের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যাবলী যেন পলকে পলকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় সিলেট শহরের শেষ প্রান্ত টিলাগড় পেরিয়ে জাফলং রোডে উঠে গেলাম। সিলেট জাফলং রোড আর সুন্দর, সুপারিসর ঝকঝকে। হৃদয়ের মাঝে উৎসারিত হতে লাগলো ভালো লাগার উথাল পাতাল ঢেউ, ছুটে চললো গাড়ী, অপরূপ সুন্দরকে চিরে চিরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি টিলা, চা বাগান আর সুদূরে ভারতের বড় বড় পাহাড় নজর কেড়ে নিচ্ছিল। পরিস্থিতিটা এমন যে কোনটা রেখে কোনটা দেখি।
শুক্রবার হওয়ায় আমরা গাড়ীর গতি পেলাম অনেক বেশী। দুপুর দেড়টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম রিসোর্টে। গাড়ী দেখেই এগিয়ে এলেন রিসোর্টের কেয়ার টেকার। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন বিনম্র ভদ্রতায় কারণ এরি মধ্যে তার সাথে আমাদের অনেকবার কথা হয়ে গেছে। জানলাম বড় বড় দাড়িওয়ালা নুরানি চেহারার মধ্য বয়সী এই ভদ্রলোকের নাম শফিকুর রাহমান। তিনি আমাদের থাকার জায়গা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, পাশের রেস্তোরায় জেনো লাঞ্চ সেরে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে এই শফিকুর রহমান তার কিছু কিছু আচার আচরণে আমাদের সম্মোহিত করে ফেললেন। তিনি হয়ে গেলেন আমদের শফিক ভাই। রিসোর্টের দায়িত্ব ছাপিয়ে হয়ে গেলেন আমাদের কেয়ার টেকার, আমাদের গাইড।
রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে অনুভব করলাম এখানে তৈরি খাবারের স্বাদ ব্যতিক্রমী এবং সুস্বাদু । সেদিন দুপুরে আমরা হাঁসের মাংস দিয়ে লাঞ্চ শুরু করেছিলাম এবং তারপর আরো সাতবার ঐ হোটেলে খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। শফিক ভাই ডাল আর ভাত ছাড়া একি আইটেম আমাদের দুইবার খেতে দেননি। স্বাভাবিক করনেই তার সাথে আমাদের একটা বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।
তাছাড়া শফিক ভাই আমাদের কাছে ছিলেন রহস্যময় একজন মানুষ। একজন কবি, একজন ভালো আবৃতি-কার। আমাদের তিন দিন দুই রাত তার রিসোর্টে অবস্থান কালে কমপক্ষে ২০ তি কবিতা আবৃতি করে শুনিয়েছিলেন। আর এই সবগুলি কবিতা ছিল পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সুনিবিড় খাপ খাওয়ানো। তিনি যেন যোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন আনন্দ আর রোমান্টিকতার। যেমন তিনি যখন আমাদের রুম বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তখন সুন্দর করে আবৃতি করেছিলেন:
স্বাগতম প্রকৃতির মাঝে
অপরূপ রূপের অবলোকনে,
করেছি সামান্য আয়োজন
চোখ খুললেই জেনো দেখা যায়
আকাশের নীল, পাহাড়ের চূড়া
ঝলমলে জলপ্রপাত ঝরনাধারা
যখনি পড়বে মনে
হোক বর্ষ পরে…
মন জেনো হয় আত্মহারা…
উল্লেখ্য, আমাদের রুমের জানালা দিয়ে আমরা তখন দেখতে পাচ্ছিলাম গাঁড়ও সবুজ সুউচ্চ ভারতীও পাহাড়, গাছ গাছালী, পাহাড়িদের সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর, ঝর্ণাধারা আর অপরূপ নীল আকাশ।
আমরা প্রথম দিন দুপুরের খাবারের পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম জাফলং এর জলধারার। স্বচ্ছ পানি বয়ে যাচ্ছে, পানির নিচের পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কত যে কর্মকাণ্ড সেখানে। কেউ পাথর তুলছে, কেউ বালি, কেউবা পর্যটক দের নিয়ে ব্যস্ত। কথা হলো পাথর তুলছেন এমন একজন শ্রমিকের সাথে। জানতে পারলাম তারা যে নিখুঁত গোল গোল পাঁথরগুলো এখান থেকে আহরণ করে এগুলো বাস্তবে এখানে জন্মায় না। শত শত মাইল দূরে পাহাড় থেকে খসে পড়া এবড়ো থেবড়ো পাথরগুলো পানির স্রোতে গড়াতে গড়াতে জাফলঙে আসে, আর এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় গড়াতে গড়াতে অজস্র ঘর্ষণে এগুলো গোলাকার ধারণ করে, যেটা আমরা যেন দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ফিনিসড প্রোডাক্ট হিসেবে পাই। যাই হোক, আমরা এসব দেখা শেষ করতে না করতে সন্ধ্যা নেমে এলো। ফিরে এলাম আমাদের রুমে।
রাতে শফিক ভাই এর সাথে রেস্তোরায় দেখা হলো। বর্ণনা করলাম কোথায় কোথায় গেলাম, কি কি দেখলাম। তিনি আমাদের বললেন, সব ঠিকই আছে তবে জাফলং এসে দুটি জায়গা না দেখা চলে গেলে জাফলং আসার কোনই মানে হয় না। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, একটি হচ্ছে নৌকা নিয়ে জিরো পয়েন্টে গিয়ে দুর্লভ প্রকৃতিকে দেখা আর আরেকটি জায়গা আছে পরে আমি নিজে নিয়ে যাবো যেখানে মধ্যরাতে যেতে হবে। দ্বিতীয় যায়গাটির বিষয়ে তিনি আমাদের মধ্যে ভীষণ একটা সাসপেন্স রেখে দিলেন। উপরন্তু দ্বিতীয় জায়গাটাতে মধ্যরাতে যাওয়ার ব্যাপারটা একটু এডভেঞ্চার মনে হলেও প্রাণের গভীরে একটা ভীতি সঞ্চালিত হয়ে গেল। শফিক ভাইকে যেন আরো রহস্যময় মনে হলো।
পরের দিন আমরা নানান যায়গায় গেলাম। নৌকা দিয়ে অপারে গিয়ে উপজাতিদের আবাসস্থল, নানান কর্মকাণ্ড , চা বাগান, বন বাদাড়ে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর বিকেলের দিকে নৌকার মাঝির সাথে চুক্তিবদ্ধ হলাম, সে আমাদের জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাবে এবং যাবতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবে। যাত্রা শুরু করতেই মাঝি বললো জিরো পয়েন্টে বেশীক্ষণ থাকা যাবে না। এখানে থাকাটা বিপদজনক ও বটে। কারণ ওইখানে যাওয়ার সাথে সাথে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা এলারট হয়ে যায় এবং সীমানা অতিক্রম না করার জন্য সতর্কবাণী দিতে থাকে। অনেক সময় বি এস এফ গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে। এতো কিছু শোনার পরো আমরা মাঝিকে এগুতে বললাম। যতই আমরা সামনে এগুচ্ছি ততোই পানির গভীরতা বাড়ছে, বাড়ছে পানির স্বচ্ছতা। দুইধারে বিশাল বিশাল গাছ গাছালিতে ভরা সুউচ্চ পাহাড় আর মাঝখানে স্বচ্ছ প্রবহমান জলধারা। দেখা যাচ্ছিলো ধেয়ে আসা মেঘমালা সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে গাছ গাছালীতে মিলিয়ে যাচ্ছে। আসলে এই অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা করার মত শব্দ ভাণ্ডার আমার নেই যা দিয়ে আমি এর ছিটে ফোটা তুলে ধরতে পারি। আমরা যখন জিরো পয়েন্টে তখন বিকেল বেলা। শফিক ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। আসলেই এই জায়গার সৌন্দর্য অতুলনীয় যা দেখে না গেলে জাফলং এসে চলে যাওয়া অনেকটা বৃথা। আমরা জিরো পয়েন্ট থেকে সুউচ্চ পাহাড়ে ভারতীয়দের তৈরি করা রাস্তা আর দুটি বড় পাহাড়কে সংযুক্ত করে তৈরি করা ঝুলন্ত সেতু কাছ থেকে দেখে অবাক হলাম। দু একটা গাড়ীও চলছে ঐ পথ দিয়ে। চোখে পড়লো বি এফ এফ এর বিশাল ক্যাম্প। সব মিলিয়ে জিরো পয়েন্ট সত্যি নয়নাভিরাম। তখনও শীতের আমেজ রয়ে গেছে। জায়গাটায় এমন একটা হিমেল বাতাস বইছিলো, যে শীতলতার ছোঁওয়া আমি পৃথিবীর কোথাও পাইনি। আসলে জিরো পয়েন্টের সৌন্দর্য আমাদের এমনি বিমোহিত করে ফেললো যে আমাদের ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। যাই হোক, মনে মনে শফিক ভাইকে ধন্যবাদ দিতে দিতে ফিরে এলাম রিসোর্টে।
এরপর ডিনারের সময় যথারীতি শফিক ভাইয়ের সাথে দেখা। বার বি কিউ চলছে। আমরাও অংশগ্রহণ করলাম। তিনি আমাদের রাত বারটায় টাইম দিলেন। গাড়ী ড্রাইভার এবং আমাদের থাকতে বললেন রিসোর্টের গেটে। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো। শফিক ভাই আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। এই পাহাড়ি জনপদে মধ্যরাতেই বা কেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক বারোটায় আমরা গাড়ী নিয়ে রিসোর্টের গেটে থামতেই শফিক ভাই ড্রাইভার এর পাশে ফ্রন্ট সিটে বসলেন। পেছনে আমরা দুই বন্ধু। এখন স্টিয়ারিং ড্রাইভার এর কাছে থাকলেও গাড়ির যাত্রাপথ নির্ধারণ করতে লাগলেন তিনি। শীতের রাত দুর্গম পাহাড়ি পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। হটাত আমাদের চোখে পড়লো বিশাল এক পাহাড়, ঝলমলে জেনো এক নিয়ন আলোর কুণ্ডলী। এত আলো কোঁথা থেকে আসছে তখন বুঝতে পারছিলাম না। আর বেশ খানিকটা পাহাড়ি পথে এগুনোর পর সেই পাহাড়ি দৃশ্য আমাদের কাছে ঝকঝকে হয়ে উঠলো। আমরা তখন ভারতের ডাউকি নগরীর নিকটতম বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থান করছি। পুরো পাহাড়টা আমাদের কাছে ছবির মত মনে হচ্ছিল। এত সুন্দর করে তৈরি করা প্রতিটি বাড়ী বৈচিত্র্যময় মনে হোল । আমার জীবনে আমি অনেক দৃশ্য দেখছি, অনেক জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু ডাউকি নগরীর এই সৌন্দর্যের মত সুন্দর খুব কমই দেখেছি। মধ্যরাতে যদিও তখন ডাউকি নগরী ঘুমিয়ে ছিল কিন্তু তার বাড়ী ঘর রাস্তা ঘাঁট প্রতি ইঞ্চি জায়গা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম জেনো স্বর্গের কোন সুনিপুণ কারিগর মর্তে নেমে এসেছিলেন এই নগরী বানাতে। যাই হোক দিনের বেলা জাফলঙে আমরা যে ডাউকি নগরী দেখি, আসলে সেটা না দেখার মতই। তারপর ওখানে আমরা আরেকটু থাকতে চাইলে শফিক ভাই বললেন, এটা একদম বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত রেখা, এখানে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। আমরা আবার ডাউকি নগরীকে পেছনে ফেলে ছুটলাম রিসোর্টের দিকে। ভাবতে লাগলাম এক শফিক ভাই আমাদের যা দেখালো বিগত সময়ে কমপক্ষে বিষবার এসেও আমি জাফলঙের এই সৌন্দর্য দেখিনি।
পরের দিন দুপুরে আমরা আবার ঢাকার পথে রওয়ানা দিলাম । মিস করতে লাগলাম শফিক ভাই, জিরো পয়েন্ট আর ডাউকি নগরীকে। আজো আমি মিস করি শেষবারের দেখা সেই জাফলং
Post Copied From:Wahid Siddiquey>Travelers of Bangladesh (ToB)