এই সিজনে অনেকেই কুয়াকাটা ভ্রমণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন । আগ্রহ জাগানোর মতোই জায়গা । সাগরকন্যা বলে কথা ।
তাই গত বছরের এইদিনে আমরা ৬ বন্ধু বেরিয়ে পরেছিলাম কুয়াকাটা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে । এক বন্ধুর বাড়ি ঐ এলাকায় হওয়ায় অনেক সুবিধা হয়েছিলো ।
লঞ্চ বা বাস দুভাবেই যাওয়া যায় ।
আমরা গিয়েছিলাম লঞ্চে ।
সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬ টায় ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে উঠলে খুব ভোরে আমতলী লঞ্চঘাটে পৌছানো যায় ।
সেখান থেকে বাসে সরাসরি কুয়াকাটা ।
লঞ্চের ভাড়া আমার মনে নেই,নামও মনে নেই 🙁
বাসের ভাড়া ১২০ টাকা ছিলো । ১ ঘন্টার মতো লাগে ।
আর সরাসরি ঢাকা থেকে বাসে যেতে চাইলে উঠতে পারেন সাকুরা,সুরভি বা গোল্ডেন লাইনে । ভাড়া বাস ভেদে কমবেশী ৬৫০ টাকা ।
আমতলী বা ঢাকা , সব বাসই একেবারে সৈকত পর্যন্ত যায় , এবং সন্ধ্যায় ওখান থেকেই ছাড়ে ।
.
ঘোরার প্লেস হিসেবে কুয়াকাটা সৈকত , সূর্যোদয় পয়েন্ট , সূর্যাস্ত পয়েন্ট(লেবুরচর),রাখাইন মার্কেট,বৌদ্ধ মন্দির গুলো আশেপাশেই ।
এছাড়া কিছুটা দূরের লাল কাঁকড়ার সৈকত সহ ১২ টা স্পটে ঘুরে আসার জন্যে ভ্যান বা বাইক রয়েছে ।
এগুলোতে গেলে আলাদা ১ টা দিন বরাদ্দ রাখা ভালো ।
.
তবে আমার একটা আফসোস , এখানে সমুদ্র নীল নয় !
শীতের মৌসুমে দিগন্ত প্রায় সারাদিনই কুয়াশা মোড়া থাকে ।
আর সমুদ্রের নিচে বেশ অনেকটা দূরত্বে সমুদ্রতট অগভীর থাকায় পানি কিছুটা ঘোলাটে ।
তাই হয়তো এই অবস্থা ।
.
সূর্যোদয় দেখতে চাইলে অবশ্যই খুব ভোরে উঠতে হবে । যাওয়ার জন্যে বাইক রয়েছে । ১ বাইকে ২ জন যাওয়া যায় ।
ভাড়া লাগামছাড়া না হলেও নির্দিষ্ট না । জনপ্রতি ৫০ টাকা লাগতে পারে ।
আর সূর্যাস্ত দেখতে চাইলে যেতে হবে লেবুরচর নামের জায়গায় ।
আমি শুনেছিলাম কুয়াকাটায় নাকি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায় ।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন ।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের স্পট বলে খ্যাত জায়গা দুটি কুয়াকাটা সৈকতের একদম দুই বিপরীত দিকে ।
সূর্যোদয় দেখতে যেতে হবে সৈকত বরাবর বাম দিকে , সূর্যাস্ত দেখতে যেতে হয় ডান দিকে ।
দু দিকেই ৪০-৫০ মিনিটের মতো লাগে ।
.
সবচেয়ে ভালো লেগেছে সূর্যাস্তের জায়গাটা ।
প্রায় জনমানবহীন এলাকা ।এইদিকে আরো সামনে গেলে সুন্দরবনের একটা অংশ পাওয়া যায় ।
তাই এখানেও এক ধরণের শ্বাসমূলসহ গাছ দেখেছি ।
সন্ধ্যায় এখানে ছোট্ট একটা বাজার বসে ।এটাকে ঠিক বাজার বলা যায়না । এতোটা জনাকীর্ণ নয় ।
আসলে সারাদিনে সমুদ্র থেকে ধরে আনা ফ্রেশ টুনা , ইলিশ সহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়া পাওয়া যায় সন্ধ্যাবেলায়।
যেগুলা কিনে দিলে ওনারাই সাথে সাথে ফ্রাই করে এনে দেন ।
বসার জন্যে সৈকতে চেয়ার টেবিল পাতা । সূর্যাস্ত দেখার পরে সন্ধ্যায় সৈকতে বসে খেতে পারেন টুনা কিংবা কাঁকড়া ।
অতি মনোরম মুহূর্ত !
আমরা পর পর দুদিন গিয়েছিলাম এখানে ।
কাঁকড়া প্রকরণভেদে ৫০-১৫০ টাকা , টুনা ২৫০ টাকার মতোন ।
কেউ গেলে এই মজা মিস করবেন না ।
.
এরকম দূরের কোনো জায়গায় গেলে বাইক বা ভ্যানের সাথে আপডাউন চুক্তি করে নিন ।
আপনাকে নামিয়ে দিবে ,আপনার মতো ঘুরে ফিরে দেখবেন । সন্ধ্যার পরে আবার নিয়ে কুয়াকাটা ব্যাক করবে ।
আসলে এখানে ভ্যান বা বাইক এমন আপডাউন চুক্তিতেই চলে ।
কাজেই আপনি যদি শুধু যাওয়ার কথা বলে যান , তাহলে ফেরার সময় আপনিও এক্সট্রা কিছু পাবেন না , ওনারাও যাত্রী পাবেন না ।
তখন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে ওনারা হয়তো চলে আসবে । আপনাকে ফিরতে হবে হেটে ।
আমাদের এভাবে একসন্ধ্যায় হেটে ফিরতে হয়েছিলো ।
ফেরার সময় রিকশা-ভ্যান-বাইক কিছুই না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে হাটা ধরেছিলাম ।
কিন্তু এই বাধ্য হওয়াটাই খুব দ্রুত আমাদের কাছে রোমাঞ্চ হয়ে উঠেছিলো ।
.
মাইলের পর মাইল অন্ধকার বালিয়াড়ি সৈকত । ডানে সমুদ্র গর্জাচ্ছে । বামে উঁচু রাস্তা ।
যতদূর চোখ যায় জনমনিষ্যিহীন ধু ধু প্রান্তর ।
মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে বালিতে নিথর পরে থাকা জেলে নৌকা ।
.
আমরা রাস্তা থেকে নেমে পরেছি। সাগরের পার ধরে ভেজা বালি পেরিয়ে হেটে চলেছি ৬ টা মানুষ ।
ডানে সমুদ্র ,বায়ে নিঃসীম প্রান্তর, আর পায়ের তলায় সাদাটে বালি ।
যা পায়ের তলায় মাঝে মাঝে রহস্যময় সাদা আলো ছড়াচ্ছে !
কি এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ! *_*
.
তবে সবার তো ৪/৫ কিমি হাটতে ভালো লাগবেনা ।
কাজেই , কেউ যদি এমন দূর্ভোগে পরেই যান , তাহলে অন্য ভ্যান ওয়ালাদের সাথে কথা বলুন । তারা তাদের পরিচিত কাউকে ফোন দিয়ে এনে দিবে ।
এক্ষেত্রে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে , আর টাকা নামেমাত্র কিছু বেশি লাগতে পারে ।
তবে আমি উপদেশ দিবো , হাটতে ভালোবাসলে ৬/৭ জনের গ্রুপ মিলে রোমাঞ্চের নেশায় হলেও ট্রাই করে দেখতে পারেন ।
আদিম রাত আর সমুদ্রের স্বাদ পাবেন ।
.
এছাড়াও কুয়াকাটায় রয়েছে বিশাল শুটকির বাজার ।
ভালো মানের শুটকি হলেও , দামে খুব একটা হেরফের নেই ।
আমরা বাসার জন্যে চ্যাপা,নোনাইলিশ,লইট্যা সহ অনেক শুটকি এনেছিলাম ।
এছাড়া রাখাইন মার্কেট থেকে বিভিন্ন পদের আঁচার , প্রসাধনী বা জামা কাপড় কিনতে পারেন ।
.
এবার ভালো করে অবশ্য মনে রাখার মতোন কিছু পয়েন্ট-
৪.রাখাইনরা সংখ্যায় অনেক হলেও তারা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে । তাই তাদের বেশি না ঘাটানোই ভালো । তবে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন ।
।
৩.যাতায়াত ব্যবস্থা বা ফোনের নেটওয়ার্ক ভালো হলেও কুয়াকাটা তার বিশালত্বের তুলনায় কিছুটা পশ্চাদপদ ।
তাই ভালো মানের হোটেল পেতে সমস্যা হতে পারে ।
আর কক্সবাজারের স্বাদ আশা না করাই ভালো ।
এখানে কক্সবাজারের মতোন বানিজ্যিকভাবে ট্যুরিজম এখনো বিস্তার লাভ করেনি , তবে ধীরে ধীরে করছে ।
সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে কিছু মানসম্পন্ন হোটেল নির্মাণ হচ্ছে ।
তখন হয়তো কক্সবাজারের মতো এখানেও মানুষ গিজগিজ করবে !
২.নিরাপত্তার সমস্যা না থাকলেও আমি এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ তেমন একটা দেখিনি । তাই সন্ধ্যার পরে ২/১ জনে দূরে কোথাও যাওয়া বা বেশি রাত অবধি দল বেঁধেও বেশি দূরে না যাওয়াই ভালো ।
কারণ সৈকতের আশে পাশে ছাড়া এলাকাটা পুরো সুনসান । তাই সতর্ক থাকা ভালো ।
***১. সূর্যাস্ত পয়েন্ট,সূর্যোদয় পয়েন্ট বা দূরের কোথাও যাওয়ার সময় বাইকে যথাসম্ভব দরদাম করে উঠুন ।
আর এই সব প্লেসে যাওয়া ছাড়া শখ করে ঘন্টা বা কিমি চুক্তিতে বাইকে উঠবেন না । আই রিপিট , ভুলেও না ।
কুয়াকাটায় যে কদিন থাকবেন অজস্র বার অজস্র প্লাটিনা হোন্ডাবাহক আপনাকে মধুর সূরে ডাকবে , ‘ মামা উঠেন । কিলো মাত্র ২০ টাকা । ‘
তাদের কথায় ভুলেছেন তো মানিব্যাগ ফাঁকা করে ছেড়ে দিবে ।
আধাঘন্টায় ৪/৫ শ টাকা খসিয়ে নিবে ।
এরা সম্ভবত শুরুতে মিটার ডাউন করে নেয়না , আপনি দেখতে চাইলে সহজে দেখাবেও না ।
আমরা একবার উঠেছিলাম , আধঘন্টায় আমাদের একেকজনের ১৫-২৭ কিলোমিটারের হিসেব দিয়ে ফেলেছিলো !
অথচ পরের দিন এরচাইতে প্রায় দ্বিগুণ দূরত্ব আমরা হেটে এসেছিলাম (লেবু্রচর থেকে , যেটা সর্বোচ্চ ৭ কিলোমিটারের বেশি কোনোমতেই হবে না )
আপনি তর্ক করে কিছু করতেও পারবেন না কারণ এরা সংখ্যায় অনেক , এবং একতাবদ্ধ । এবং বোঝা যায় এটা ট্যুরিস্টদের উপর এদের কমন ট্রিক ।
এমন অবস্থায় পরলে অন্য চালকদের সাহায্যের আশা বৃথা । তারা এসে হয়তো এভাবে মধ্যস্থতা করবে , ‘৫৮০ টাকা হয়েছে,আপনি ৫০০ টাকা দিয়েন । এই তুই ওনারে আর কিছু বলিস না ।”
তখন না জেনে ২৫০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা দিতে পেরে যাকে আপনি বিপদের সময়ের এঞ্জেল ভাবছেন , সে হয়তো এইমাত্র কারো কাছে নিজের ডেভিল রূপটা প্রকাশ করে এসেছে ।
এগুলা আমার কাছে বিরক্তিকর ধাপ্পাবাজি মনে হয় । কর্তৃপক্ষের এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত ।
অবশ্য সব ট্যুরিস্ট স্পটেই এমন কিছু অবস্থা আছেই । সেটা বেশিরভাগ সময়ই যানবাহনের বেলায়,মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ ক্যামেরাম্যানদের বেলায় ।
যার মধুর কথায় ভুলে আপনি শখের বশে তার বাইকে উঠবেন , যার মিষ্টি কথায় আপনি আরো সামনে যেতে উৎসাহ পাবেন , কিছুক্ষণ পরে তার কথার টোন আর ভাবভঙ্গি আপনার সাবেক gf/bf এর চাইতে বেশি দ্রুত চেঞ্জ হবে 😛
০.১২ স্পটের ওদিকে গেলে বাইকে আপনাকে ডাকতে পারে , “মামা চলেন রাখাইন পল্লী, ‘যা চাইবেন সব পাবেন ‘ ”
এহেন ‘লোভনীয় ‘ ও নিষিদ্ধ আনন্দের দিকে পা না বাড়ানোই ভালো ! কে জানে , হয়তো জীবনসংশয়ও ঘটে যেতে পারে কোনো চক্রের হাতে !
-১.সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই অবশ্যই সতর্ক থাকুন ।
আর গলা পানি বা তারচেয়ে বেশি দূরে না যাওয়াই উত্তম । কারণ অগভীর সমুদ্রের টান এখানে বেশ প্রবল । আর ভাটার সময় একদমই নামবেন না । আমরা আপনার ভেসে যাওয়ার খবর পত্রিকায় পড়তে চাই নাহ ।
আপনি ভেসে গেলে হয়তো কেউ খেয়ালই করতে পারবেনা সমুদ্রস্নানের উচ্ছাসে ।
আফটার অল , ভীড়ের মধ্যেই মানুষ সবচেয়ে একা থাকে !
.
.
বন্ধুরা মিলে বন্ধুর সাথে যাওয়ায় আমার খরচের সাথে কারোটা মিলবে না ।
তাই ‘ট্যু দ্য পয়েন্ট’ হিসেব দিলাম না ।
তবে ৩৫০০-৪০০০ টাকায় ভালোভাবেই সম্ভব বলে মনে করি ।
Post Copied From:Al Xayeed>Travelers of Bangladesh (ToB)