চুপিচুপি টাইগারহিলে

আজ দার্জিলিং ভ্রমণের শেষ দিন। মনটা বড্ড মেঘলা! ফিরে যাবার জন্য নয়! এজন্য যে টাইগার হিল যাওয়া হলনা! ভ্রমণ সঙ্গীরা সবাই তৃপ্ত তাঁদের এবারের ভ্রমণ নিয়ে। সুতরাং আর কোথাও যেতে চায়না, কেউই! অথচ সবাইকে বোঝালাম যে যাব তো সকালে। জীপ নিজেদের। শিলিগুড়ি যাবার পথেই তো পড়বে। একটু আগে বের হতে হবে এই যা!

কিন্তু অতো ভোরে কেউই এই হিম ঠাণ্ডা শীতের সকালে লেপের উষ্ণতা ভেঙে বের হবেনা! আমার মনের ভিতর খচখচ, দার্জিলিং এলাম অথচ এতো জনপ্রিয় টাইগার হিলে গেলাম না! সেটা কি মেনে নেয়া যায়! সমস্যা হল আমার কাছে আর অবশিষ্ট কোন রুপিই নাই! সুতরাং একা-একা যে যাবো সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ!

রাতে ডিনার করে বেদনা নিয়ে ঘুমোতে ঢুকলাম। লেপের তলায় শরীর ওম হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনে ওম নেই! কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম। একসময় ঘুম ভাঙল, স্বাভাবিক নিয়মে মধ্যরাতের শেষে। আবার বিছানায় যাব, এমন সময় চোখ গেল রুমের দেয়াল ঘড়ির দিকে। রাত ৩:৩০ পার হয়ে গেছে। মনে পড়লো আরে যারা টাইগার হিল যায়, এই সময়ই তো বের হয়!

রোমাঞ্চের বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীর, মন ও মাথায়! বেরিয়েই দেখিনা, যদি কোন হৃদয়বান ব্যাক্তি বা গ্রুপ পাওয়া যায়, একটু নিয়ে যাবে দয়াকরে! বহু মানুষই তো যাবে। কাউকে না কাউকে নিশ্চই পাওয়া যাবে! আমার মন বলছে যেতে পারবো! সুতরাং বেরিয়েই দেখিনা কি হয়? মনকে তো বোঝাতে পারবো যে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি!

যেই ভাবা, সেই কাজ। প্রস্তুত হলাম নতুন ও নিজস্ব এডভেঞ্চারের নেশায় মাতাল হয়ে! ডেকে তুললাম আর এক জনকে। যে না গেলেও অন্তত বাঁধা দেবেনা! আমার প্রস্তুতি আর উদ্যম দেখে সেও উঠে গেল এবং তৈরি হয়ে নিল!

৪ টা বাজে। দুজন হোটেল বয়কে ডেকে, গেট খুলে বের হলাম। চারিদিকে রাতের শেষ অন্ধকারের হাতছানি। একটু অজানা আশংকা অচেনা অন্ধকারে! সামান্ন গাঁ ছমছমে শিহরণ! সব মিলে একটা কেমন-কেমন অনুভুতি। অব্যাক্ত, গুমোট, খিটখিটে মোট কথা সুখকর নয় আদৌ! হোটেলের নিচু থেকে উপরে রাস্তায় উঠে মনের বিসন্নতা বিলীন হয়ে গেল একনিমিশেই!

এতরাতে চারিদিকের কোলাহল আর কলকাকলি দেখে! সেই সাথে হাজারো জীপের বহর দেখে। আলোয়-আলোয় আলোকিত পুরো রাস্তা। আগে-পিছে, দূরে যতদূর চোখ যায়, আলো আর আলো! ঝলমলে চারিদিক দেখে! এবার মনটা খুশিতে নেচে উঠালো। সম্ভাবনা নিশ্চই আছে। সুযোগ পাবই, এই ভেবে!

দুজন মিলে অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও তেমন কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলাম! সবাই ব্যাস্ত নিজেদের নিয়ে। অন্য কোনদিকে কারো খেয়াল করার সময় কোথায়? আর সবচেয়ে বড় কথা সব গাড়িই ভরপুর! কাউকে অনুরোধ করার কোন সুযোগই নেই!

এবার আমার সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার কাছে কোন রুপি আছে কিনা? নেই! একদমই নেই! আর কোথাও যাওয়া হবেনা যেনে গতকাল রাতেই সব খরচ করে ফেলেছে! শুধু টাকা আছে তাও মাত্র ৫০০! আর আমার কাছে তো শুরু থেকেই নেই। আমার কাছেও আছে মাত্র ৫০০ টাকা! কিন্তু অদম্য ইচ্ছা আর চেষ্টা থাকলে বিধাতা যে কাউকেই নিরাশ করেননা তারই প্রমান হল আবারো! এবং দারুণ নাটকীয়তায়! বলি সেই গল্প….

দুজনে বিরস বদনে বসে-বসে দেখছি অন্যদের দুর্বার যাত্রা! মানিক বন্দোপাধ্যয়ের সেই উক্তির মত “দুই ক্ষুধার্ত কুকুর! সুখ পাচ্ছে অন্যদের খাওয়া দেখে!” আসলে টাইগারহিল দেখতে যাওয়া দেখে!

পিছন থেকে গাড়ির আওয়াজ। আমাদের কে সরে যাবার ইশারা। গাড়িটি আমাদের ক্রস করে যেতে-যেতে আবার থেমে গেল! সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক। ছোট একটি কার নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উদেশ্যে তার জিজ্ঞাসা? টাইগারহিল যাব নাকি! আমরা বিস্মিত, আরে বলে কি? এই ভেবে। হ্যাঁ যাব কিন্তু রুপি নাই! তার উত্তর ডলার তো আছে?

নাহ! আছে বাংলাদেশী টাকা! যাবে?

সে দ্বিধান্বিত। আসলে তার বাবা কলকাতা গেছে। গাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। এইজন্য কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায় বেরিয়েছে, কাউকে না জানিয়ে! সে যেতে চায় কিন্তু বাংলাদেশী টাকার মান নিয়ে তার ধারনা নেই। তাকে বোঝালাম যে মান প্রায় কাছাকাছি, ভারতের ১০০ টাকা আমাদের ৭৫ টাকার চেয়েও বেশী। সুতরাং সে ১০০০ টাকায় যেতে পারে। এতে তার ৭৫০ টাকা হবে।

সে একটু অনিশ্চতা আর কিছুই না পাওয়ার চেয়ে অল্প পাওয়া ভাল এইসব ভেবে-ভেবে শেষ পর্যন্ত সম্মত হল! আর আমাদের আনন্দ! সে ছিল সীমাহীন! আরও একবার নিজেকে নিজে সাধুবাদ জানালাম। অদম্যতা আর হার না মানার সাহসিকতার জন্য। শেষ দেখে ছাড়া মানসিকতার জন্য এবং জয়ী হবার সম্ভাবনার জন্য।

আমরা চলছি, ভীষণ দ্রুত গতিতে। যেহেতু বেশ দেরি হয়ে গেছে। সূর্য উদয়ের মুহূর্ত উপভোগ করতে না পারলে তো আর কোনোই লাভ নেই! চলছি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের একপাশে গভীর খাঁদ, একপাশে খাড়া পাহাড়ের ছোট রাস্তা ধরে। ঘুম স্টেশন পেরিয়ে দুটো বা তিনটা পাহাড় ডিঙ্গানোর পরেই শুরু হল জ্যাম! সারি-সারি গাড়ি পুরো রাস্তা জুড়ে! যেহেতু ছোট গাড়ি। জায়গা খুবই কম লাগে। সেহেতু সেইসব গাড়ির সারি ভেদ করেই চলছে আমাদের টগবগে যুবক। অতিরিক্ত সামান্ন অর্থের সন্ধানে আর আমাদের শেষ রোমাঞ্চের স্বাদ দিতে।

এভাবে আরও ২০ মিনিট চলার পরে আর কোনো ভাবেই যাওয়া যাচ্ছেনা! কিন্তু আর বেশী দুরেও না। সুতরাং নেমে গেলাম কার থেকে। যুবকের নাম্বার নিয়ে। এবার শুরু পাহাড় চড়ার পালা। পাগলের মত উঠছি, পাহাড়ের লতাপাতা, গাছের শিকড়, ইটপাথর উপেক্ষা করে! রাস্তা ধরে গেলে দেরি হব।, তাই সর্টকার্ট করে, ট্রেকিং পদ্ধতি অনুসরন করে! সারা গায়ে ধুলো-বালু, কাঁদা, হাতের ছিলে যাওয়া, সব জয় করে পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত চুড়ায়! টাইগারহিলের শীর্ষে!

ভিড় আর ভিড়, মানুষ আর মানুষ! যেন মেলা বসেছে বছর শুরুর! আবারো সবকিছু উপেক্ষা আর বকাবকি তুচ্ছ করে চলে গেলাম সামনে! সূর্যি মামা শুধু আমাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল! শুধুই আমাদের জন্য!

কাঞ্চনজঙ্ঘার রুদ্ধশ্বাস রূপে আরও হাজারো রঙে রাঙিয়ে দিয়ে রঙিন হয়ে উঠছে সূর্য তার সকল সৌন্দর্য নিয়ে! কত যে রঙের খেলা, কত যে খেয়ালি কাঞ্চনগঙ্ঘা আর কিজে এক অব্যাক্ত অনুভূতি? যার প্রকাশ ভাষায় অসম্ভব! এ শুধু গিয়ে, দেখে নিজের মত করে অনুভবের।

আমার ভাষায় বর্ণনা অসাধ্য। সেই ভাষাই যে নেই! দারুণ স্বার্থক ও শতভাগ আনন্দের ভ্রমণ পুরোপুরি পূর্ণতায় পরিসমাপ্ত।

POst Copied From:Sajol Zahid‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Leave a Reply

Your email address will not be published.